
কভিড-১৯: আলবেনিয়ায় ভুয়া খবরের দাপটে যেভাবে কোনঠাসা সঠিক তথ্য
Author: BD FactCheck Published: November 6, 2020, 6:09 pm | Updated: November 7, 2020, 9:49 pm
মার্চের শেষের দিকে আলবেনিয়াতে যখন পুরোপুরি লকডাউন, তখন স্টেফানো মন্টানারি নামের একজন ইতালীয় ফার্মাসিস্ট যিনি নিজেকে একজন ন্যানোপ্যাথোলজির ডক্টর মনে করেন, ইউটিউবে এক ইন্টারভিউতে দাবি করেন, করোনা সাধারণ জ্বর এর বেশি কিছুনা।
তিনি আরো বলেন, “এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে শরীর নিজে নিজে সেটি প্রতিরোধ করে। ফলে সারা দুনিয়ায় সরকারের এসব কঠোর পদক্ষেপের কোনো দরকার নেই”।
৭১ বছর বয়সী মন্টানারি কোন বৈজ্ঞানিক দলের সাথে যুক্ত নন, আবার তিনি চিকিৎসকও নন। এছাড়া তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি বলে দাবি করেছে ফ্যাক্ট চেকিং সাইট নিউজগার্ড।
তার ঐ স্বাক্ষাতকারের ভিডিও আলবেনিয়ার ভাষায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তার বক্তব্য মিডিয়ার ক্লিকবাজি সাংবাদিকতা এবং সরকারের জনগনের সাথে যোগাযোগের অভাবের দরুণ খুব দ্রুতই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
লোকে এরপর থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, করোনা বলে কিছু নেই বা সবকিছুই ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব, বলে মনে করে ইতালীয় ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা ফ্যাক্টা এর সম্পাদক কামিলা ভাগনোজি।

ভাগনোজি জানায়, “উক্ত ব্যক্তির মতামত দেয়ার ফলে বেশিরভাগ মানুষ তার বক্তব্যে বিশ্বাস করে ফেলে এবং সবাই মনে করে তিনি যা বলছেন বাকিরা তাই বলতে চান”।
ইউকে-ভিত্তিক টুল ‘বাজসুমো’ ব্যবহার করে জানা যায়, সম্প্রতি প্রকাশিত সব খবরের মধ্যে করোনা সংক্রান্ত খবর সবচেয়ে বেশি পড়া হয়েছে। সেখানে সবচেয়ে বেশি রিএকশন পাওয়া প্রধান ২০টি আর্টিকেল বাছাই করলে দেখা যায় সেখানে ৯৩ হাজার রিএকশন এসেছে। উল্টোদিকে ২০টি চিহ্নিত ভুয়া খবরে রিএকশন এসেছে ৬৮ হাজার যা আগের অংশের চেয়ে মাত্র ২৮ ভাগ কম।
এদের মধ্যে GazetaKorrekte.com এর উক্ত ‘বিশেষজ্ঞ’ মন্টানারির একটি বক্তব্যকে নিয়ে করা খবরে রিএকশন এসেছে ৮ হাজার। এছাড়া কেবলমাত্র মার্চের ১৪-১৭ এই ৩ দিনে মন্টানারি-সংক্রান্ত খবরে এসেছে ২৭ হাজার রিএকশন।
তবে এই ব্যাপারে ফেসবুক এবং মণ্টানারির বক্তব্য প্রচারকারী ইউটিউব চ্যানেল বিবলো’র কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া মণ্টানারি নিজে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছেন তা তিনি স্বীকার করতে চান না।
তিনি ইমেইলে জানান, “আমি ভুয়া নিউজ ছড়াতে আগ্রহী এমন কোনো তথ্য আপনারা পেয়েছেন?”। এছাড়া তার বক্তব্য ইউটিউব সরিয়ে দিয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি বলেন, “তারা ভয় পেয়েছে”।
নিউজগার্ডের মতে, বিবলো “ধারাবাহিকভাবে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে এবং বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে খবর প্রচার করেছে”। মার্চে আরেকটি স্বাক্ষাতকারে মন্টানারি সেখানে বলেন, করোনায় মৃত্যু এতই কম যে মনে হয় “করোনার অস্তিত্বই নেই”। এছাড়া হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারটিকে ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেন তারা।
কিন্তু আমরা জানি, ইতালিতে করোনায় ৩৮ হাজার মানুষ মারা গেছে।
এছাড়া ফ্যাক্টা সম্পাদক ভাগনোজ্জি সামাজিক মাধ্যমগুলোর দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। যেমন রোবার্তো পেটরেলা নামের একজন ডাক্তার আগস্টে দাবি করেন যে, করোনা মূলত মানুষের তৈরি এবং এটি তৈরি করা হয়েছে জনসংখ্যা কমাতে। ভিডিওটি সেপ্টেম্বর ১০ তারিখ পর্যন্ত ১.৩ মিলিয়নের বেশি দেখা হয়েছে।
ভাগনোজ্জি আরো বলেন, এই সংকট কেবল চিকিৎসা বিষয়ক খবরেই নয়, ফাইভ জি নিয়েও কিছু গুজব সেখানে ছড়িয়েছে।
এছাড়া তিনি আরো বলেন “করোনা মহামারিতে যেই ব্যাপারটি কিছূটা আলাদা ছিল সেটি হল মানুষ তখন ব্যাপক আতংকিত ছিল। এবং মানুষ বুঝতে পারছিল না কী সে বিশ্বাস করবে আর কী করবেনা”।
যদিও ফেসবুক ভুয়া তথ্য মোকাবেলায় কাজ করেছে, কিন্তু তাদের এড়িয়ে অনেক গুজব ছড়িয়েছে।
ভাগনোজ্জি আরো বলেন, “ফেবসুক এবং ইউটিউব ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেলেও আমজনতাকেও জানতে হবে কোনটি ভুয়া আর কী সত্য”।
এছাড়া আলবানিয়ান এক পত্রিকায় রাশিদ বুত্তার নামে এক লোক একটি প্রবন্ধে দাবি করে যে, করোনা আসলে আমেরিকা এবং আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিসেস এর পরিচালক এন্থনি ফাউসির আবিস্কার। উক্ত লেখক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োলজি এবং থিওলজি পড়েছেন বলে দাবি করেছেন।
উক্ত লেখাটি ৩ হাজারের বেশি রিএকশনসহ প্রায় ৬০০ শেয়ার হয়েছে।
তবে উক্ত আর্টিকেলে যা বলা হয়নি তা হল, রাশিদ বুত্তার একজন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আবিস্কর্তা এবং ভ্যাক্সিন-বিরোধী প্রচারণাকারী।
১১ মে এর আরেকটি লেখায় ডানপন্থী আইরিশ ফ্রিডম পার্টির নেতা অধ্যাপক ডলোরেস কাহিল দাবি করেন “প্যান্ডেমিক মূলত একটি প্রপাগান্ডা যা মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা বানিয়েছে যাতে তারা জনগণের অধিকার হরণ করে তাদের অসুস্থ্য করে পরে ভ্যাক্সিন নিতে বাধ্য করতে পারে”।
পরবর্তীতে ইউটিউব এবং ফেসবুক তার এই লেখা ভুয়া হিসেবে সরিয়ে নেয়। এছাড়া তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, উক্ত বক্তব্য অধ্যাপক কাহিলের নিজস্ব।
আরো গবেষণায় উঠে এসেছে, আলবেনিয়া গুজবের একটি উত্তম ঘাটি। সেখানে অক্টোবরের এক গবেষণায় জানা যায়, সেখানকার ৭০ ভাগ লোক মনে করে, করোনা আসলে চীনের এক ল্যাবে তৈরি করা।
এছাড়া ৬৫ লোক মনে করে এই ভাইরাসটি বানানো হয়েছে ক্ষমতার জন্যে কিংবা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবসা বাড়াতে।
এছাড়া তিনভাগের এক ভাগ লোক মনে করে, করোনা মহামারিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফাইভ জি’র ভূমিকা আছে।
আলেবনিয়ান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টোজে’র পরিচালক ক্লোদিয়ানো কাপো জানান, জনগণের সঠিক তথ্য প্রাপ্তির অভাবের অনেকটা দায় আলবেনিয়ার সরকারি দপ্তরগুলোর।
কাপো বলেন, “আমরা করোনার শুরু থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্যে স্বচ্ছতার অভাব দেখেছি। এবং মন্ত্রনালয় থেকে যা বলা হচ্ছে তা যাচাই করার সুযোগ দেয়া হচ্ছেনা”।
“মহামারি আসাতে অবশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য প্রদানে কিছুটা গতি এসেছে”।