
দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাস: সীমিত পরীক্ষা কি প্রকৃত ভয়াবহতা আড়াল করছে?
Author: BD FactCheck Published: August 30, 2020, 11:21 pm | Updated: August 30, 2020, 11:23 pm
ভারতে এই মুহুর্তে আমেরিকা ও ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে এবং সংখ্যাটা ২৬ লাখেরও বেশি।
বিরাট জনসংখ্যার দেশ হিসেবে এই সংখ্যা খুব বেশি অবাক করার মত নয়। তবে ভারতের আশেপাশের দেশগুলোতে করোনা মহামারীর কী অবস্থা?
দক্ষিন এশিয়াতে কী আক্রান্তের সংখ্যা বিপর্যয়ের আকার ধারণ করছে?
মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউন যখন ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করে, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যাও তার সাথে বাড়তে শুরু করে। যা এখন প্রতি ২৪ দিনে দ্বিগুন হারে বাড়ছে।
টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর ফলে প্রতিদিন রেকর্ড-সংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা দেখা গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৭ লাখেরও বেশি টেস্ট করা হচ্ছে সেখানে।
যাই হোক, দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে ঘটনা ভিন্ন। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দেখা যাচ্ছে কমতে শুরু করেছে যা মে-জুনের সময় উঠতি ছিল।
এই অঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা পাকিস্তানে থাকলেও বর্তমানে সেখানে আশার রেখা দেখা যাচ্ছে। দেশটিতে জুনের মাঝামাঝিতে প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজারের মত আক্রান্ত হলেও এখন আগস্টে এসে সেটা হাজারের নীচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৭৯ হাজার ১৪৪ জন। জুনের মাঝামাঝিতে দৈনিক সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ থাকলেও জুলাই এর শেষ সপ্তাহ এবং আগস্টের শুরুতে সেটা কমতে থাকে।
যদিও ঈদ উদযাপনের পর জুলাই এর শেষদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা আশঙ্কা ছিল।
সেখানে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হলেও পাকিস্তানে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
মধ্য-জুনে একবার বৃদ্ধির পর আফগানিস্তানেও আক্রান্তের সংখ্যা এখন কমতির দিকে। যদিও সেখানকার সরকারি হিসাবের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে সেদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশেরও বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।
নেপালে দেশটির সরকার সেখানে ১০০ দিনের লকডাউন কার্যকর রেখেছিল এবং সেসময় আক্রান্তদের বেশিরভাগ ছিল ভারত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়। সেখানকার কিছু জনবহুল এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে কয়েকটা প্রদেশে স্থানীয়ভাবে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
শ্রীলংকাতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশ কমই। এপ্রিলে কিছুটা বেশী থাকলেও সেটা তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম ছিল। দেশটিতে বেশ কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থাসহ আক্রান্তদের চিহ্নিত করা এবং কোয়ারেন্টাইন নিয়মাবলীর ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি ছিল।
দক্ষিন এশিয়ায় করোনা টেস্ট কী পরিমান হয়েছে?
বিশ্বের চারভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা দক্ষিন এশিয়ায় বাস করলেও মোট করোনা আক্রান্তের কেবল ১৫% এই অঞ্চল থেকে চিহ্নিত হয়েছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহিদ জামিলের মতে, ‘’প্রতি মিলিয়নে ভারত এবং দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কম, কিন্তু প্রতি মিলিয়নে আবার টেস্টের সংখ্যাও কম।’’
তিনি আরো বলেন, এসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক বেশি হলেও সেখানকার মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম।
ভারত এখন পর্যন্ত ৩০ মিলিয়ন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে এবং পাকিস্তান ২.২ মিলিয়নের বেশি। কিন্তু জনসংখ্যার হিসাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় এই দেশগুলোতে টেস্ট অনেক কম হচ্ছে।
এছাড়া পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে করোনা টেস্ট এর সংখ্যা কমে এসেছে, যার প্রভাব করোনা সনাক্তের হিসেবেও পড়ছে।
জুনে পাকিস্তানে প্রতিদিন ৩১ হাজারের বেশী মানুষের করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং ২৭ জুলাই দেশটির সর্বোচ্চ সংখ্যক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে যা সংখ্যায় ৪১ হাজার ৬৬৬ জন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে টেস্টের সংখ্যা দ্রুত নেমে এসেছে যা আগস্ট মাসের ৩ তারিখ ১০ হাজার ৭৫৯ জনে দাড়িয়েছে। তারপরে অবশ্য আবার কিছুটা বেড়েছে করোনা টেস্টের সংখ্যা।
জুলাইতে পাকিস্তান সরকার সেখানকার রাজধানী ইসলামাবাদে একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে বলা হয় শুধু ইসলামাবাদেই প্রায় ৩ লাখ করোনা আক্রান্ত রোগী থাকার সম্ভাবনা আছে যাদের বেশিরভাগের দৃশ্যত কোন লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশেও জুলাইয়ে সরকার টেস্টের ফী বাড়িয়ে দেয়ার পর করোনা টেস্টের সংখ্যা কমে এসেছে। এছাড়া ভুয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রির মত ঘটনাও সেখানে ঘটেছে।
নেপালে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯০৭টি টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে যার দৈনিক টেস্টের হার ছিল প্রায় ১০ হাজার।
আফগানিস্তানে কী পরিমান করোনা টেস্ট হয়েছে তা জানা যায় না। রেড ক্রিসেন্ট তাদের উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে সরকারের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে বাস্তবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি দেশ বা অঞ্চলের জন্য একজন সনাক্তকৃত রোগীর বিপরীতে ১০ থেকে ৩০ টি টেস্টের একটা হার নির্ধারণ করে দিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো এই ব্যাপারটি কমই মানছে।
রাশিয়া এবং জাপানের জনসংখ্যা প্রায় বাংলাদেশের সমান হলেও সেখানে টেস্ট বেশী হচ্ছে এবং প্রতি ৩৫ থেকে ২৯ টি টেস্টে একজন করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ৫ টি টেস্টে অন্তত একজন করোনা আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে যা জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রার খুবই নিচে।
নেপালে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রতি ২০টি টেস্টে একজন পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছিল যা ১৪ জুন পর্যন্ত ছিল প্রতি ২৫ জনে একজন।
দক্ষিন এশিয়ায় করোনা মৃত্যুহার কেমন?
পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এখানে করোনায় মৃত্যুহার বেশ কম, সেটা সামগ্রিকভাবে হোক কিংবা মাথাপিছু হারে হোক। এটি বেশ ইতিবাচক শুনালেও জনস্বাস্থ্যে তুলনামূলক কম ব্যয় করা এই অঞ্চলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
‘অনেক মৃত্যু ঘটনা নিবন্ধনের হিসেবে আসেনি এবং উপসর্গ অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা নির্ধারণে বেশ ভুল্ভ্রান্তি আছে” জানিয়েছেন ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কামরান সিদ্দিকী।
কিন্তু ডঃ শাহীদ জামিল বলেন, যদিও অনেক মৃত্যু হিসেবে আনা যায়নি, তারপরেও অন্যান্য দেশের সাথে এখানকার করোনা মৃত্যুহারের তফাত “বেশ চোখে পড়ার মত”।
ডঃ সিদ্দিকী বলেন, ‘’এই কম মৃত্যুহারের একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় দক্ষিণ এশীয়ার জনসংখ্যায় তরুণদের সংখ্যা বেশী।’’
সাংবাদিক শ্রুতি মেননের প্রতিবেদনটি বিবিসি রিয়ালিটি চেক থেকে বিডি ফ্যাক্টচেক কর্তৃক অনূদিত