
‘নির্দোষ’কে ‘ধর্ষক’ বানানোয় মিডিয়া, বাহিনী ও মব-এর ভূমিকা
Author: BD FactCheck Published: January 10, 2021, 6:11 pm | Updated: January 10, 2021, 6:11 pm
গত ৭ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। নিহতের নাম আনুশকাহ নূর আমিন (১৮)। এ ঘটনায় ওই দিনই চার তরুণকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতাল থেকে আটক করে পুলিশ। তরুণরা আনুশকাকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো। যদিও হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসকরা জানান, সেখানে পৌঁছার আগেই মেয়েটি মারা গেছে।
এই ঘটনার পর পুলিশ কিভাবে ঘটনাটি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেছে, মিডিয়ায় কিভাবে এ সংক্রান্ত খবর পরিবেশিত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে কিভাবে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষ (mob) প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে- এসবের কিছু কিছু চিত্র আমরা এই লেখায় দেখবো।
পুলিশ কী জানিয়েছে:
সর্বশেষ পুলিশ জানিয়েছে, চার সন্দেহভাজনের মধ্যে একমাত্র দিহান ছাড়া বাকি তিনজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ৯ জানুয়ারি বাংলাট্রিবিউনকে রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন যা বলেছে তার কিছু অংশ তুলে দেয়া হলো–
“সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি দিহানের তিন বন্ধুর বিরুদ্ধে। শুক্রবার রাতেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া মামলার এজাহারে ও দিহান ছাড়া অন্য কাউকে আসামি করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার কোনও সত্যতা না পাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুচলেকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে তুলে দেওয়া হয় ৩ জনকে।
তবে তদন্তের স্বার্থে যে কোনও তথ্যের জন্য জিজ্ঞাসাবাদে তাদের ডাকা হতে পারে বলেও জানান সাজ্জাদ হোসেন।”
কিন্তু ঘটনার একদম শুরুতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো উল্টো তথ্য। তখন পুলিশ কী বলেছিলো দেখুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর নিন্মোক্ত প্রতিবেদনে—

প্রতিবেদনের ভেতরের স্ক্রিনশট দেখুন–

অর্থাৎ, পুলিশ ঘটনার প্রথমে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলো, সন্দেহভাজন হিসেবে আটক চারজন মিলে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে।
অবশ্য পুলিশের এমন বক্তব্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ছাড়া অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এখন আর পাওয়া যায়নি (১০ জানুয়ারি অনলাইনে খোঁজা হয়েছে)।
মিডিয়া কী বলেছে?
৮ জানুয়ারি সময় টিভির ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, “রাজধানীতে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ-হত্যা: আগেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে অভিযুক্তরা”।

অর্থাৎ, ধর্ষণ ও হত্যা মামলা একমাত্র আসামি এবং তার সাথে আটক হওয়া তিন সন্দেহভাজনের সবাই গণধর্ষণ এবং হত্যার মতো ‘একই রকম’ ঘটনা ঘটিয়েছিলো- এমনটাই বুঝা যাচ্ছে এই শিরোনাম থেকে।
কিন্তু নিচের স্ক্রিনশটে পুরো রিপোর্টটা পড়ুন–

শিরোনামের তথ্যটির সাথে সংশ্লিষ্ট একটি প্যারা আছে পুরো রিপোর্টে (ইন্ট্রো ছাড়া)। সেই প্যারাটি হলো–
“নির্যাতিতার মা বলেন, আমার মেয়ের বান্ধবীর ভাই আমাকে বলেছে ওই ছেলেকে তারা চেনে। ওই ছেলে আগেও এরকম ঘটনা ঘটিয়েছে। ওর আচরণ ভাল না।”
কিন্তু এই প্যারায় দেখা যাচ্ছে, নিহতের মা “আগেও এরকম ঘটনা” ঘটাবার অভিযোগ করছেন মূল অভিযুক্ত দিহানের বিরুদ্ধে। কিন্তু সময় টিভির প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ইন্ট্রোতে ‘অভিযুক্তরা’ লেখা হয়েছে। অর্থাৎ, “আগেও এরকম ঘটনা” ঘটানোর দায় বাকি তিনজনের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ভুলভাবে; নিহতের মায়ের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ করা হয়নি।
আরও লক্ষ্যণীয়, সময় টিভির শিরোনামটি ‘উপসংহারমূলক’। “আগেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে অভিযুক্তরা” এটা নিশ্চিত তথ্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। নিহতের স্বজনের অভিযোগ আকারে নয়।
দিহান সংক্রান্ত খবরের কভারেজে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো।
৮ জানুয়ারি সারাবাংলা ডটনেট এর একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে।

খবরে দেখা যাচ্ছে, রমনা জোনের উপ কমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বলছেন, আনুশকা ধর্ষণের শিকার কিনা তা ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা যাবে।
কিন্তু একই দিন প্রকাশিত সময় টিভির একাধিক প্রতিবেদনে দিহানের নামের সাথে ‘ধর্ষক’ শব্দটি লিখেছে।



যদিও পরে ময়নাতদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে, তারা ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন। দেখুন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন।
সাধারণ মানুষের আদালত:
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারো কারো বরাতে কিছু সংবাদমাধ্যমের খবরে যখন ধারণা দেয়া হয়েছে যে, দিহান এবং তার তিন বন্ধুর সবাই “ধর্ষক”, এরপরই শুরু হয় সাধারণ মানুষের ‘আদালতের বিচারিক কার্যক্রম’। সামাজিক মাধ্যমে দিহানের সাথে তার বন্ধুদের ছবি এবং ফেসবুক আইডির স্ক্রিনশট নিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পেইজে পেইজে। তাদের পরিবার পরিজনকে হেয় করে পোস্ট দেয়া হয়েছে অসংখ্য প্রোফাইল ও আইডি থেকে। অন্য মানুষজন এসব ‘ধর্ষকদের’ এবং তাদের স্বজন পরিজনের প্রতি জানিয়েছেন ঘৃণা। অনেক জায়গায় আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে “এসব ধর্ষকদের’ শায়েস্তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
নমুনা হিসেবে একটি ভাইরাল ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন নিচে–

নিচের স্ক্রিনশটের মাঝখানের অংশটি ফেসবুকে ‘ফটো সার্চ’ দিয়ে নেয়া। এমন অসংখ্য পোস্টে দিহানে সাথে তার বন্ধুদের ছবিতে ‘রেপিস্ট’ লিখে ছড়িয়েছেন সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।

পুলিশ বাহিনীর কারো বরাতে মিডিয়ার একাংশে তিনজন তরুণকে ‘ধর্ষক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর তাদেরকে নিয়ে ‘ফেসবুক মব’ এর গণপ্রচারণা শেষে পুলিশ বাহিনীই আবার জানালো ওই তিনজনের কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধর্ষণ বা হত্যায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিলো না। অথচ গত তিন দিন ধরে বাহিনী, মিডিয়া এবং মব-এর অসাবধানতা এবং অতিউৎসাহের এই তিন ‘নির্দোষ’ তরুণ সারাদেশে ‘ধর্ষক’ হিসেবে পরিচিত ছিলো।