
নির্বাচন নিয়ে ছড়ানো গুজবের চেয়ে কোভিড ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য বেশী ক্ষতিকর হতে পারে
Author: BD FactCheck Published: December 24, 2020, 7:23 pm | Updated: December 24, 2020, 7:23 pm
সামাজিক মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিয়ে ভুল তথ্যের প্রচার যেন থামছেই না। খোদ মার্কিন দেশ ভ্যাকসিন প্রাথমিক ধাপে থাকলেও ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুয়া খবর জনগণের মাঝে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
এসব গুজবের শুরুটা হয়েছিল ভ্যাকসিন গ্রহণে মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে এমন কিছু দাবি দিয়ে। তারপর দাবি করা হয় এই ভ্যাকসিন গ্রহণে ডিএনএ বদলে যেতে পারে। এছাড়া ভাইরাসের মিউটেশনের সাথে ভ্যাকসিন পরিবর্তন সম্ভব নয় বলেও গুজব অব্যাহত আছে। তবে এসব ভিত্তিহীন দাবি এখন আবার বিস্তারিত বর্ননাসহ দেখা যাচ্ছে যা নানা ধরনের প্রভাব তৈরি করছে। কেননা ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে ক্ষমতাসীন সরকার এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের অনাস্থা বিরাজমান আছে।
এছাড়াও সামাজিক মাধ্যমগুলো এসব গুজবের বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তারা এখনো সফল নয়।
এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পল ব্যারেট বলেন, “ব্যাপারটা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের ইস্যুটাই নতুন। এর অনেক তথ্য এখনো পরিস্কার নয়। কোন চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্ট বলতে পারবেনা, এটির ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা ১০ বছর ধরে কাজ করছি। কেউ বলতে পারবেনা আমরা এই ভ্যাকসিন এর ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত। ফলে এসব বিষয়ই আমাদের মধ্যে নানা ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করছে।”
অন্যদিকে টেক্সাসের একজন নেতৃত্বস্থানীয় রিপাবলিকান মাইকেল বুরগ্রেস এর দাবি, “আমার মনে হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমগুলো এ ধরণের ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে বেশ হিমশিম খাবে।” কেননা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক দাবি থাকে যার একাংশ ভাল, কিন্তু আরেকাংশ বিভ্রান্তিকর। ফলে এসব তফাত করতে যেয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে বেশ বেগ পেতে হবে।
তাছাড়া হাউজ ইণ্টেলিজেন্স এর চেয়ারম্যান এডাম শিফো মনে করেন, “ভ্যাকসিনের প্রতি অনাস্থা নানাভাবে বেড়ে চলছে”। এছাড়া তিনি মার্কিন করোনা-টাস্কফোর্স টিমে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে একজন গবেষককে যুক্ত করতেও দাবি তোলেন জো বাইডেনের কাছে। কেননা পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণামতে, এখনো মানুষ ভ্যাকসিন নিতে অনাস্থা দেখাচ্ছে। ফলে আমেরিকাকে দ্রুত মহামারিমুক্ত করতে এটি ও একটি বাধা।
এন্টি ভ্যাকসিন আন্দোলনগুলোর কার্যক্রম নতুন নয় এবং টেক কোম্পানিগুলোও বেশকিছু বছর ধরে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। তবে করোনার সময়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাটা স্বাভাবিক কারণেই আগের চেয়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। করোনা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি স্পষ্ট না হওয়ায় এসব ভ্যাকসিন-বিরোধী ক্যাম্পেইন কিছুটা সফল হতে পারছে। যেমন বলা হয়েছে, এই ভ্যাকসিন শিশুদের শরীরে প্রবেশ করলে প্রতিবন্ধী হবার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ভ্যাকসিনের বেলায় এটি বারবার মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। এছাড়া করোনার ভ্যাকসিন আরো নতুন পদ্ধতি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে সেটাও একাধিক ফ্যাক্টচেকিং সাইট জানিয়েছে। ফলে আংশিক তথ্য এবং সরকারগুলোর প্রতি অনাস্থাই গুজবে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে। এসব এন্টি-ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইনের সাথে ‘কিউআনোন’ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যুক্ত হওয়ায় এন্টি-ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন আরো হালে পানি বেশি পাচ্ছে বলে জানান মেলানি স্মিথ নামের একজন মিডিয়া এনালিস্ট। “কিউআনোন মূলত একটি সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন করে ভ্যাকসিন-বিরোধীতা” বলেও জানান তিনি।
এন্টি-ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইনের আরো কিছু তত্ত্ব আছে, যার মধ্যে, আমেরিকার বিখ্যাত সংক্রমণ-রোগ বিশেষজ্ঞ এন্থনি ফাউসের ভ্যাকসিন-ব্যবসা থাকার দাবিটি অন্যতম। এরকম ভুয়া তথ্য তো নির্বাচনী সময়ের ভুয়া তথ্যের চেয়েও ভয়াবহ। কেননা, রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডায় ব্যক্তির ক্ষতি হওয়ার সুযোগ কম থাকে। এছাড়া এই মহামারি শুধু দেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যেই একটি বিশাল ইস্যু।
এ ব্যাপারে স্মিথ মনে করেন, এই সমস্যাটি বৈশ্বিক এবং একই সাথে সারা দুনিয়ার শাসকদলের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটও একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘকে ঘিরেও একাধিক ভুয়া তথ্য দেখা গেছে যা এ দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের ভূমিকাকেও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
হিমশিম খাচ্ছে সিলিকন ভ্যালি
যদিও মহামারীর শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, করোনা নিয়ে গুজবেরও একটি মহামারি দেখা দিতে পারে। তখন অবশ্য টেক জায়ান্টরা দাবি করেছিল, তারা এই গুজব মোকাবেলায় প্রস্তুত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, তাদেরকেও মোকাবেলার নীতি বদলাতে হচ্ছে। ফেসবুক ডিসেম্বরের শুরুতে বলেছিল, তারা করোনা সংক্রান্ত সকল ভুয়া খবর সরিয়ে নিবে। তাদের মুখপাত্র আরো বলেছিলেন, যেসব কন্টেন্ট তারা সরিয়ে নিবে সেসবের কোনো বিস্তারিত তথ্য দিতেও তারা বাধ্য থাকবেন না।
টুইটারও একইভাবে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা করোনা নিয়ে ক্ষতিকারক সকল কন্টেন্ট সরিয়ে নিবে এবং বিভ্রান্তিকর পোস্টের সাথে ফ্লাগ লাগিয়ে দিবে। ইউটিউব এবং টিকটকেও একই নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশ কিছু ফাঁকফোকর আছে।
“এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হবে সবচেয়ে সফল প্রচেষ্টা” বলে মনে করেন আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিজিটাল ফরেন্সিক রিসার্চ ল্যাবের গ্রাহাম ব্রুকি। তিনি টেক কোম্পানিদের নেয়া উদ্যোগগুলোকেও “অসম্পূর্ণ” বলে দাবি করেন। কেননা ফেসবুকসহ বেশিরভাগ সামাজিক মাধ্যমগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর এবং এটি এখনো বলার মত সফল নয়।
এছাড়া নানা ভিত্তিহীন ভিডিওগুলো সরিয়ে নিতে ভিডিও প্লাটফর্মগুলোও শুরুতে তেমন সফল হয়নি। ‘প্লাণ্ডেমিক’ এর ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে বলা হয়েছে ভ্যাকসিন মূলত বড় কোম্পানিগুলোর একটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার। উক্ত ভিডিওটি হয়ত একটি প্লাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি নানাভাবে একাধিক প্লাটফর্মে পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আসল ভিডিওটির কোনো হদিস পাওয়া না গেলেও সেটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলাপ চলতেই থাকে।
তবে সামাজিক মাধ্যমগুলো এসব গুজব রুখে দেয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছে বলেও অভিযোগ করেন ব্রুকি। ফলে তাদের উপর পর্যবেক্ষকদের আরো বেশি আশা ছিল। এছাড়া এন্টি ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইনের এখন মূল আখড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন প্রাইভেট/ক্লোজড গ্রুপ এবং গ্রুপ চ্যাট। ফলে সেখানে কাজ করা এখনো দৃশ্যত অসম্ভব।
তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর উচিত ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুল তথ্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে দীর্ঘমেয়াদে নীতি ঠিক করা। এছাড়াও ভ্যাকসিন নিয়ে যে পরিমাণে ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়কালে ভাইরাল হওয়া গুজবগুলোর চেয়ে বেশি ক্ষতিকর, এমনটাই মনে করেন নিউজ গার্ডের সহ-পরিচালক স্টিভ ব্রিল।
তিনি আশংকা করেন, “জানুয়ারিতে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুয়া তথ্যের প্রচার ১০ গুণ বাড়বে। তখন হয়ত ভ্যাকসিনগুলোর নাম ধরে ধরে নির্দিষ্ট করে ভুয়া তথ্য অথবা পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা চালানো হবে।” ব্রিল আরো বলেন, আগামি তিন মাস আমাদের সবার জন্যে বেশ স্পর্শকাতর সময় কেননা তখন কেবলমাত্র ভ্যাকসিন জনসাধারণের নাগালে আসতে থাকবে। হয়ত ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের বিরুদ্ধেই প্রচারণা চালাবেন যারা এখনো তা পান নি। তখন পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারেই বলে তার ধারণা।
জানা যায়, মার্কিন কংগ্রেসে এই বিষয়টি এখন বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কংগ্রেসের একটি টাস্কফোর্স কমিটি এই ‘ইনফোডেমিক’ রুখে দাড়াতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মার্কিন কংগ্রেসের এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়া উচিত। তাছাড়া, বাইডেন ভুয়া তথ্য ঠেকানোর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী এবং এক্ষেত্রে তিনি কিছু আইনের সংশোধনের দিকেও যেতে পারেন। তবে এখনো এটি দেখার বাকি তিনি কতটা সাড়া দেন এবং ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধের এই ক্রুসেডে তার সরকারকে যুক্ত করেন কিনা।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যারেট মনে করেন, টেক প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নীতি প্রণয়ন করলেও সেগুলোকে আরো বেশি প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করতে হবে। হয়ত অনেকের কন্টেন্ট সরিয়ে নিলে সে দুঃখ পেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখন সংকটকাল এবং এই সংকটে আমাদের সবাইকে ভুমিকা রাখতে হবে।
পলিটিকো অবলম্বনে