ফিচারড নিউজ

ফিচারড নিউজ

January 20, 2021, 4:11 pm

Updated: January 23, 2021, 3:01 am

বিদ্বেষপ্রসূত পরিবেশনায় একটি খবর যেভাবে ভুল বার্তা দেয়

Author: BD FactCheck Published: January 20, 2021, 4:11 pm | Updated: January 23, 2021, 3:01 am

“করোনা টিকা নেওয়ার পর মুখ বাঁকা হয়ে গেছে অনেক ইসরাইলীর” শিরোনামের একটি খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। দেখুন সেরকম একটি স্ক্রিনশট–

বেশ কিছু অনুল্লেখযোগ্য অনলাইন পোর্টালে খবরটি একই শিরোনামে এবং একই ছবি ব্যবহার করে প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে কে প্রথমে খবরটি প্রকাশ করেছে খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে দৈনিক ইত্তেফাকের ১৮ জানুয়ারি দুপুরে প্রকাশিত একটি খবর।

আর্কাইভ লিংক দেখুন এখানে

এছাড়া insaf24.net নামে আরেকটি পোর্টাল ইত্তেফাকের এই খবরটি পুনঃপ্রকাশ করেছে।

insaf24.net এর প্রতিবেদনটি মূলত ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের কপি-পেস্ট ভার্সন হলেও (ইত্তফাকের কয়েক ঘণ্টা পরে প্রকাশিত এবং হুবহু বাক্য/প্যারা মিলে যায়) ইত্তেফাকের চেয়ে insaf24.net প্রতিবেদন ফেসবুকে তুলনামূলক অনেক বেশি শেয়ার হয়েছে। ফলে insaf24.net এর প্রতিবেদনটিকে ধরেই এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

২০১৬ সালে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন অনলাইন পাঠকের ৬ জন কোনো খবরের লিংকে ক্লিক না করেই, অর্থাৎ, শুধু শিরোনাম পড়েই সেটিকে রি-টুইট করে থাকেন বা ফেসবুকে শেয়ার করে থাকেন।

এ সংক্রান্ত ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট থেকে নিচের বাক্যটি তুলে দেয়া হলো–

“59 percent of links shared on social media have never actually been clicked: In other words, most people appear to retweet news without ever reading it.”

পুরো রিপোর্ট পড়ুন এখানে বা এখানে

insaf24.net এর যে রিপোর্টটি তাদের ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হয়েছে সেটি (এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) ৪২১ বার শেয়ার হয়েছে (উপরের স্ক্রিনশট দেখুন)। এই প্রতিটি শেয়ার যদি একজন ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে এবং আমরা যদি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণাকে আমলে নিই, তাহলে ধরে নিতে হবে এই ৪২১ ব্যক্তির ২৪৮ জন (৫৯ শতাংশ) লিংকটিতে ক্লিক না করেই শুধু শিরোনাম পড়ে খবরটি শেয়ার করেছেন।

একটি ওপেন সৌর্স সফটওয়্যার দিয়ে দেখা যাচ্ছে, insaf24.net এর প্রতিবেদনটি ফেসবুকে মোট শেয়ার হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ বারের বেশি। যদি প্রতিটি শেয়ার একজন ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে তাহলে ৪ হাজার ১২ জন ব্যক্তি খবরটির ভেতরে কী আছে তা না পড়েই শেয়ার বাটনে ক্লিক করেছেন বলে সন্দেহ করা যায়।

এর বাইরে আরো অনেক অনলাইন পোর্টালে খবরটি পুনোরুৎপাদিত হয়েছে যার স্ক্রিনশট শুরুতেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কতজন মানুষ পড়েছেন বা শেয়ার করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়।

ফলে আমরা শুধুমাত্র insaf24.net এর ইউআরএল-টি কতজন মানুষ ভেতরের খবর না দেখে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকতে পারেন, এবং তাদের নিজেদের ধারণা (পারসেপশন) তৈরি করে থাকতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনা করবো।

গবেষণাকে আমলে নিয়ে আমরা সম্ভাব্য যে ৪ হাজার ‌১২ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছি যারা প্রতিবেদনটির ভেতরে কী লেখা হয়েছে তা না পড়েই নিজেদের পারসেপশন তৈরি করেছেন খবরটি সম্পর্কে, তারা আসলে কী জেনেছেন শিরোনাম থেকে?

তারা ধরে নিয়েছেন, “অনেক” ইসরাইলী নাগরিকের “মুখ বাঁকা” “হয়ে গেছে” ভ্যাকসিন নেয়ার পর। এবং শিরোনামের সাথে দৃশ্যমান ছবি থেকে তারা ধারণা নিয়ে থাকবেন যে, ছবিতে যেভাবে দেখা যাচ্ছে তেমনভাবে বাঁকা হয়েছে তাদের মুখ।

কিন্তু খবরের ভেতরে “অনেক” শব্দের ব্যখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে ‍”অনেক” মানে “১৩ জন রোগী”।

খবরের ভেতরে না পড়া ৪ হাজার ১২ জন লোক এটাও ধরে নেয়ার সুযোগ আছে যে, যাদের “মুখ বাঁকা” হয়েছে তাদের মুখ হয়তো আর সোজা হয়নি, বা হবে না।

কিন্তু খবরের ভেতরে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির বক্তব্য দেয়া হয়েছে যেখানে তিনি বলছেন, ২৮ ঘণ্টা পর তাদের মুখের সমস্যা সেরে গেছে।

যারা শিরোনাম পড়েই খবরটি শেয়ার করেছেন তারা এটিও জানেন নি, খবরের ভেতরে বলা হয়েছে আক্রান্ত ১৩ জনের মুখে ভ্যাকসিনের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে তা “মৃদু” বা “মাইল্ড সাইড ইফেক্ট”; গুরুতর কিছু নয়।

অর্থাৎ, insaf24.net এর যেসব পাঠকরা এই প্রতিবেদনটি যারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে সহায়তা করেছেন তাদের একটি বড় অংশ মূল খবরে যা বলা হয়েছে তার চেয়ে ভিন্ন এবং ভুল ধারণা পোষণ করে থাকার সুযোগ রয়েছে।

এবার দেখা যাক যেসব পাঠক ফেসবুকে পোস্ট করা লিংকে ক্লিক খবরটির ভেতরে প্রবেশ করেছেন তারা কী ভুল ধারণা পেয়ে থাকতে পারেন?

প্রথমত, শিরোনামে “অনেক” শব্দ ব্যবহার করলেও ভেতরে সেটির ব্যবহার নেই। বরং ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে ১৩ জনের “মৃদু ফেসিয়াল প্যারালাইসিস (মুখ বেঁকে যাওয়া”র তথ্য দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই তথ্যও দেয়া হয়েছে যে, এমন মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।

insaf24.net এর প্রতিবেদনে এই তথ্য নেই যে, কতজনকে ভ্যাকসিন দেয়ার পর এই ১৩ জনের মধ্যে মুখাবয়ক বেঁকে যাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

যদিও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম www.wionews.com-এর রিপোর্টেও এই তথ্য নেই। ইসরায়েলি আরেক সংবাদমাধ্যম জেরুসালেম পোস্ট জানিয়েছে, এই ১৩ জন ব্যক্তি মোট ২০ লাখ ভ্যাকসিন গ্রহীতার মধ্য থেকে আক্রান্ত হয়েছেন।

ভ্যাকসিন গ্রহীতা এবং মুখাবয়বে প্রভাব ফেলা আক্রান্তের সংখ্যার তুলনা করলে (প্রতি দেড় লাখে একজন প্রায়) তা আর “অনেক” হিসেবে পাঠকের কাছে গণ্য হয় না; যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে insaf24.net এর শিরোনামে।

যারা insaf24.net এর প্রতিবেদন পড়েছেন এবং যারা না পড়ে শিরোনাম দেখে শেয়ার করেছেন উভয়পক্ষের সামনেই এই তুলনামূলক তথ্যটি না থাকায় এ বিষয়ে তাদের ভুল ধারণা (আতঙ্ক) তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

আবার insaf24.net এর রিপোর্টে আক্রন্ত একজন রোগীর বক্তব্যের একাংশ দেয়া হয়েছে। অন্য অংশে তিনি যে বলেছেন ২৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তার মুখে মাইল্ড Bell’s Palsy সিম্পটম থাকা ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হয়নি- এসব কথা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং মূল ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে থাকলেও ইনসাফ এর রিপোর্টে দেয়া হয়নি। রোগী নিজে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে “রেয়ার” বা বিরল বলেও মন্তব্য করেছেন। সেটিও ইনসাফ এর রিপোর্টে নেই।

এছাড়া এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য আসলেই ভ্যাকসিন, নাকি গ্রহীতার শরীরে কোনো বিশেষ অবস্থা দায়ী সে বিষয়েও নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা এমন তথ্য দিয়েছে খবরের মূল উৎস Ynet; কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি এবং insaf24.net এর রিপোর্টে এসব কথার উল্লেখ নেই। এর আগে নরওয়েতে ভ্যাকসিন গ্রহীতা বেশ কয়েকজন রোগী মারা যাওয়ার পরে তদন্তে দেখা গেছে ভ্যাকসিনের সাথে তাদের মৃত্যুর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বয়স্ক ওই গ্রহীতাদের শারিরীক অন্যান্য বিভিন্ন অবস্থার কারণে তারা মারা গিয়েছেন।

insaf24.net এর রিপোর্ট পড়ে পাঠকরা নিশ্চিতভাবে ভ্যাকসিনকেই এ জন্য দায়ী করার মতো ভুল করতে পারেন।

ছবি দুটি পুরনো:

ইত্তেফাক এবং insaf24.net এর রিপোর্টে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো কভিড ভ্যাকসিন গ্রহণের পর কারো মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়ার ছবি নয়। বরং ছবিগুলো পুরনো। ২০১৭ সালে ইতালির একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইটে bell’s palsy এর দৃষ্টান্ত হিসেবে ছবি দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখুন এই লিংকে

তারাও অন্য একটি ওয়েবসাইট (www.mw-fp.com) থেকে ছবিগুলো নিয়েছে বলে ক্রেডিটে উল্লেখ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোতে ছবির কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি।

রিপোর্টে জাতিবিদ্বেষী শব্দের ব্যবহার এবং পাঠকের মন্তব্যে সেটির প্রভাব:

আলোচ্য খবরটি ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকদের ভ্যাকসিন গ্রহণের খবর। ইসরাইল রাষ্ট্র বা রাজনীতি সংক্রান্ত কোনো ইস্যু খবরের মূল ফোকাস নয়। কিছু রোগাক্রান্ত সাধারণ মানুষের শারিরীক দুর্দশার তথ্য জানানোই খবরটির ফোকাস। এমন একটি খবরের শুরুর বাক্যটি insaf24.net এ লেখা হয়েছে এভাবে– “ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলে করোনার টিকা নেওয়ার পর অন্তত ১৩ জনের মৃদু ফেসিয়াল প্যারালাইসিস (মুখ বেঁকে যাওয়া) হয়েছে।”

“ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র” এই শব্দগুলোর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। ইসরাইল রাষ্ট্রের কয়েকজন সাধারণ নাগরিকের রোগাক্রান্ত হওয়ার খবরের শুরুতে “ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র” বলার মাধ্যমে এই রোগাক্রান্ত সাধারণ মানুষকে “ইহুদীবাদী সন্ত্রাসীদের” সাথে সরাসরি সম্পর্কিত করা হয়েছে। তারা ওই রাষ্ট্রের নাগরিক বা অন্যভাবে বললে, ইসরায়েল তাদেরও রাষ্ট্র। এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রটি শুধু “ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র” হয়ে থাকলে এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরাও “ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী” তকমার বাইরে যেতে পারেন না। আর কোনো “সন্ত্রাসী”র শারিরীক দুর্দশার খবরকে কেউ কেউ “খারাপ” খবর হিসেবে না দেখে বরং “সুখবর” হিসেবে দেখতে পারেন। এবং সেটাই দেখা যাচ্ছে insaf24.net এর রিপোর্টের পাঠকদের উল্লেখযোগ্য অংশের ক্ষেত্রে। তারা ১৩ জন ইসরায়েলি সাধারণ নাগরিকের শারিরীক অসুস্থ্যতার খবরটিকে “সুখবর” হিসেবে নিয়েছেন। দেখুন খবরটির নিচে কিছু মন্তব্য–


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *