
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নামে ভুয়া ডকুমেন্ট বানিয়ে মাস্ক বিরোধী প্রচারণা
Author: BD FactCheck Published: August 30, 2020, 5:42 pm | Updated: September 4, 2020, 5:09 pm
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মহামারীর সময় মুখে মাস্ক পরার নির্দেশনা দেয়না এরকম তথ্য সম্বলিত একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে যেখানে ডকুমেন্টটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক এই সংস্থাটি বলছে এটি তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি, বরং বিভিন্ন সূত্র থেকে আংশিক তথ্য সংগ্রহ করে এই ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থার মত তারাও নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক পরার উপর জোর দিচ্ছে।

৫ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লোগো সম্বলিত ডকুমেন্টটির সাথে ‘’WHO কী প্রকাশ্যে মাস্ক পরতে পরামর্শ দেয়? সহজ উত্তরঃ না।” এই ক্যাপশনসহ একই ফেসবুক পোস্ট করা হয়। ছবিটিতে এই দাবীর সমর্থনে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথাও উল্লেখ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যে গভর্নর প্রার্থী হিসেবে পরাজিত রিপাবলিকান রাজনীতিবীদ রবার্ট ফস্টারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘’আপনাকে মিথ্যা বলা হচ্ছে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন। এটাই সত্য।’’ এই ক্যাপশন দিয়ে ছবিটি পোস্ট করা হয় যা ৫৪০ বারের বেশী শেয়ার হয়েছে।
অন্যান্য ফেসবুক ও টুইটার আকাউন্ট থেকে কানাডিয়ান একটি সাইটের একটি রিপোর্ট শেয়ার করা হয় যার শিরোনাম ছিল “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ব্যাপকভাবে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা পায়নি, তবে পরার পরামর্শ দিচ্ছে” যেখানে ফেসবুকে শেয়ার হওয়া ছবিটিকে ফিচার করা হয়।
ছবি শেয়ারিং এর সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রামেও এরকম দাবী ছড়িয়েছে।
অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মারগারেট হ্যারিস এএফপিকে ইমেইল জানান, ‘’WHO এমন কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে যারা এটি বানিয়েছেন তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে তথ্য নিয়ে নিজেদের মত করে তুলে দিয়েছেন।”
একই ছবির ব্যাপারে ওরিগন হেলথ এন্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটির মেডিকেল ইনফরম্যাটিকস অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলজি এর অধ্যাপক ডঃ রজার চৌও এই ছবিটিতে কিছু গবেষণার তথ্যকে আংশিকভাবে তুলে দেয়ার ব্যাপারটির প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘’এটি বিভিন্ন সূত্র থেকে ইচ্ছেমতো তথ্য নিয়ে বানানো একটি ডকুমেন্ট। এতে মাস্কের মাধ্যমে হাঁচি কাশি জনিত শ্লেষার কার্যকর ফিল্টারিং ও প্রতিরোধের ব্যপারটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া মাস্ক যে কার্যকর এ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এখানে আমলে নেয়া হয়নি।”
উক্ত ছবিটিতে মাস্ক পরা নিয়ে বিভ্রান্তিকরভাবে চারটি দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রথম দাবিঃ ‘’সকল পর্যায়ে মাস্কের ব্যবহারের কার্যকারিতার কোন প্রমান নেই।’’
এটি মূলত ২০১২ সালের একটি গবেষণা থেকে নেওয়া। যার শিরোনাম ছিলঃ “Facemasks, Hand Hygiene, and Influenza among Young Adults: A Randomized Intervention Trial.” দেখুন,
এই গবেষণাটি ২০০৭-০৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা এর সময়কার, সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারী এর নয়। এছাড়া সেখানে গবেষক বলেন, যারা কেবল মাস্ক পরে এবং যারা মাস্ক এর সাথে হাত ধোয়ার শিষ্টাচার মেনে চলে তারা ইনফ্লুয়েঞ্জার মত রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
উক্ত গবেষণার উপসংহারে বলা হয়, ‘’ইনফ্লুয়েঞ্জার মত মহামারির শুরুতে জনাকীর্ণ স্থানে এরকম নন-ফার্মাসিউটিক্যাল পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া উচিত।’’
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সম্প্রতি এরকম একটি গবেষণার উল্লেখ করেছে যেখানে দেখা গেছে মিসৌরিতে একটি চুল কাটার সেলুনে সকলে মাস্ক পরার কারণে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারেনি। সেলুনটির দু’জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত এটা জানার আগে তারা ১৩৯ জন কাস্টমারকে সেবা দিলেও মাস্ক থাকার কারণে কোন কাস্টমারই সংক্রমিত হননি।
দ্বিতীয় দাবিঃ “বিভিন্ন সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার মত নানা মহামারীতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সুতি কাপড়ের মাস্ক ব্যবহারকারীরা সার্জিকাল মাস্ক ব্যবহারকারিদের চেয়ে বেশি ঝুকিতে আছে।”
এটিও নেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালের একটি গবেষণা থেকে। দেখুন,
যার শিরোনাম ছিল, ‘’স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কাপড়ের মাস্ক ও সার্জিকাল মাস্ক ব্যবহারের তুলনামূলক পরীক্ষা”। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কাপড়ের মাস্ক পরা লোকেরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুকিতে বেশি থাকে। কিন্তু তারপরও এর গবেষকেরা সুরক্ষার প্রয়জনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া তারা করোনাভাইরাসের সময় একটি বিশেষ বার্তা দিয়েছেন ।
যেখানে তারা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই শ্বাস-প্রশ্বাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
তৃতীয় দাবিঃ মাস্ক পরলে জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ‘’নিরাপদ থাকার ত্রুটিপূর্ণ বিশ্বাস তৈরি তে পারে এবং এতে অন্যান্য স্পর্শকাতর সচেতনতার প্রতি অবহেলা তৈরি হতে পারে।”
কোন গবেষণা ছাড়াই এই দাবিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ২০২০ এর জুনে মাস্ক পরা সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় সাবধানতা হিসেবে বলা হয় যে ব্যাপকভাবে মাস্ক পরার সম্ভাব্য একটা ঝুঁকি হলো এতে মিথ্যা একটা নিরাপদ অনুভুতি চলে আসতে পারে যার ফলে মানুষ সামাজিক দূরত্ব ও হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বীকৃত পদক্ষেপ নিয়ে অবহেলা করতে পারে।
তবে ওরিগন হেলথ এন্ড সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ চৌ এ ব্যাপারে জার্মানির একটি গবেষণা থেকে বলেন, “মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বেশী মেনে চলছেন।’’
চতুর্থ দাবিঃ “সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ৪৫৫ জন লক্ষণহীন করোনা রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা করোনা ছড়াচ্ছেন না।’’
এ দাবির পক্ষেও ২০২০ সালের একটি গবেষণার কথা বলা হয়েছে। যার শিরোনামঃ “A study on infectivity of asymptomatic SARS-CoV-2 carriers.”
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলভারম্যান এবং তার দল এই গবেষণার পদ্ধতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, “এই গবেষণার লেখককে আরো সচেতন হওয়া দরকার ছিল যে তার এই গবেষণা যাতে SARS-COV2 ভাইরাস ‘ছড়ায় না বা কম ছড়ায়’ এমন দাবীর পক্ষে দলিল হিসেবে ব্যবহৃত না হয়”। দেখুন,
সিলভ্যারম্যান এএফপিকে ইমেইলে আরো জানান, ‘’উক্ত গবেষণার গবেষণাকারীরা স্বীকার করেছিলেন এটা একটি মাত্র কেস স্টাডির সংক্ষিপ্ত ফলাফল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং এটা ‘সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য’ এমন বক্তব্য দিয়েছেন।’’
এএফপি উক্ত গবেষণার গবেষকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা উত্তর দেননি।
এছাড়াও ২০২০ এর জুন মাসে স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সল্যাশনাল ইন্সটিটিউটের ড্যানিয়েল ওরান ও এরিক তোপল একটি রিভিউ আর্টিকেলে দেখান, ‘’লক্ষনহীন রোগীদের করোনা ছড়ানোর হার প্রায় ৪০-৪৫%। এছাড়া তারা সংক্রমিত হওয়ার প্রায় ১৪ দিনের পরও অন্যকে সংক্রমিত করতে পারেন।”
মাস্ক পরার উচিতঃ
উহানে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মাস্ক পরা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতে কেবল স্বাস্থ্যকর্মী ও সংক্রমিতদের মাস্ক পরতে বললেও পরে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে জনসাধারণ সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়। দেখুন।
এছাড়া আমেরিকার সিডিসি পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ড এক বিবৃতিতে বলেন, “ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে ও প্রতিহত করতে মাস্ক সবচেয়ে উপযোগী একটি অস্ত্র। বিশেষ করে কমিউনিটি পর্যায়ে চলাফেরার ক্ষেত্রে।’’ দেখুন।
কানাডার প্রধান জনস্বাস্থ্য অফিসার ডঃ থেরেসা তাম ২০শে মে থেকে মাস্ক ব্যবহারে পক্ষে বিবৃতি দেন। দেখুন।
প্রতিবেদনটি এএফপি ফ্যাক্ট চেক থেকে বিডি ফ্যাক্টচেক কর্তৃক অনূদিত