
ভাইরাল হওয়া ‘নির্দেশনা’টি কি জামায়াতে ইসলামীর?
Author: BD FactCheck Published: October 29, 2020, 6:30 pm | Updated: October 31, 2020, 12:18 am
জামায়াতে ইসলামীর ‘অভ্যন্তরীণ দলীয় নির্দেশ’ দাবি করে কিছু নির্দেশনা সম্বলিত একটি নোটিশের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এরকম কয়েকটি পোস্ট আর্কাইভ করা আছে এখানে, এখানে ও এখানে।নোটিশটি দেখুন নিচে–

BD FactCheck এর অনেক পাঠক নোটিশটির সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের জন্য অনুরোধ করেছেন। এ সংক্রান্ত যাচাইয়ে প্রাপ্ত তথ্যাদি নিচে তুলে ধরা হলো।প্রথমত, “সম্মানিত অঞ্চল পরিচালক ও জেলা/মহানগরী আমীরগণের উদ্দেশ্যে” শীর্ষক নোটিশটি কোনো ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ নয়। ফলে এটি সংক্রান্ত কোনো খবর মূলধারার সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।সূত্রহীন:ফেসবুকে প্রথম ৭ অক্টোবর দুপুরে এই নোটিশটি প্রকাশ করে “সেই রাজাকার এই রাজাকার” নামে একটি ফেসবুক পেইজ।আর্কাইভ করা পোস্টটি দেখুন এখানে।

পোস্টটি বলা হয়েছে, “জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণ বন্ধ রেখে ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে মুতআ বিবাহ জোরদার করার আহবান জানিয়েছেন এমন একটি নির্দেশনা আমাদের হাতে এসেছে।”যেহেতু নির্দেশনাটি জামায়াতের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়নি, এবং এটির কন্টেন্ট যেহেতু দলের অভ্যন্তরীণ গোপনীয় বিষয় সংক্রান্ত, ফলে এটি প্রকাশ হওয়ার অর্থ হলো একটি ‘স্পর্শকাতর গোপন নথি ফাঁস’ হওয়ার ঘটনা। এ ধরনের স্পর্শকাতর নথি প্রকাশের দাবি করা হলে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতার স্বার্থে কিভাবে নথিটি পাওয়া গেছে এবং কোন বা কী ধরনের সূত্র থেকে পাওয়া গেছে তার যাচাইযোগ্য তথ্যভিত্তিক বর্ণনা থাকা বাঞ্ছনীয়।কিন্তু আলোচ্য পোস্টে এমন কিছুই ছিলো না। শুধু বলা হয়েছে, “আমাদের হাতে এসেছে”। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন ‘ভাব বাচ্য’র ব্যবহার উপস্থাপিত তথ্যের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।অবশ্য পোস্টটি প্রকাশের পর নোটিশে থাকা বিভিন্ন ভুল ও অসঙ্গতি নিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন তোলা শুরু করলে “সেই রাজাকার এই রাজাকার” নামক পেইজটি থেকে পোস্টটি বারবার এডিট করা হয়েছে। তৃতীয় বারের এডিটে দাবি করা হয়েছে নোটিশটি “দক্ষিণ বঙ্গের এক আমীরের সূত্র থেকে ইমেইলের মাধ্যমে পাওয়া”।নিচে মূল পোস্টটির এডিট হিস্টোরি দেখুন–


তথ্যে ভুল:নোটিশটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণটি হলো নোটিশে দেখা যাচ্ছে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ‘ডাঃ শফিকুর রহমান’ এর নাম লেখা। এবং তার বর্তমান (৫ অক্টোবর ২০২০) পদবী হিসেবে লেখা রয়েছে “সেক্রেটারী জেনারেল”।প্রকৃতপক্ষে, ডা. শফিকুর রহমান বর্তমানে জামায়াতের আমীর। তিনি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আমীর নির্বাচিত হয়ে এরপর থেকে একই দায়িত্ব পালন করছেন। দেখুন মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর।নোটিশের সত্যতা নিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়ার পর প্রকাশকারী পেইজের পোস্টটি এডিট করে ‘বিঃদ্রঃ” যোগ করা হয়েছে। তাতে ‘আমীর’কে ‘সেক্রেটারী জেনারেল’ উল্লেখ করা তথ্যগত ভুলের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে– “শফিক চোরা সেক্রেটারি লেখা আছে। কিন্তু সে জামায়াতের আমীর তা সবাই জানে। এটা বানানো হলে তো ভুল তথ্য থাকতো না। এটা যে একশভাগ সত্যি এখন বোঝা গেল কারণ শফিক আমীর হয়েছে কিছুদিন আগে, সেক্রেটারি থেকে হয়েছিল। তাই পুরানো প্যাডে প্রিন্ট দিয়েছে।”এখানে “এটা বানানো হলে তো ভুল তথ্য থাকতো না” এই বাক্যাংশ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, নোটিশে “ভুল তথ্য থাকাটাই নোটিশটির সত্যতার প্রমাণ” হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু যেই নোটিশ বা নথিকে ‘দলের অভ্যন্তরীণ গোপনীয়’ বলে দাবি করা হচ্ছে সেই একই নোটিশকে দলের নেতাকর্মীদের কাছে ‘সত্য’ হিসেবে প্রমাণ করতে কেন দলের আমীরের পদবী ভুল করা হবে আমীর নিজের স্বাক্ষরকৃত নিদের্শনায়- তার ব্যাখ্যা পোস্টে নেই। বরং দলের গোপনীয় নির্দেশনামায় দলের সর্বোচ্চ পদধারীর পরিচয়ে ভুল তথ্য থাকলে জুনিয়র নেতাদের কাছে সেই নির্দেশনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়ার কথা, যা মূলত নির্দেশনা বাস্তবায়নের পথে একটি অন্তরায়।অসঙ্গতি:নোটিশটির উপরের ডান দিকে দেখা যাচ্ছে সেটি ইস্যু করার তারিখ হিসেবে লেখা রয়েছে “৫ অক্টোবর ২০২০”। কিন্তু নোটিশের ভেতরের বর্ণনায় লেখা হয়েছে, “বিগত ০৫/১০/২০২০ তারিখে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়।”অর্থাৎ, যেদিন নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে সেই দিনই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হলেও বলা হয়েছে ‘বিগত ০৫/১০/২০২০ তারিখে’। যদি ৫ অক্টোবর নোটিশ পাঠানো হয়ে থাকে তাহলে ‘বিগত দিন’ এর মানে হলো বৈঠক ৫ অক্টোবরের আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর বৈঠক ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলে নোটিশ পাঠানো হয়ে থাকলে সেই দিনটি ‘বিগত’ হয় ৫ অক্টোবরের পরের কোনো দিনে। এই অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যগুলোর কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয় তা প্রশ্নবিদ্ধ।নোটিশে আরেকটি গুরুতপূর্ণ অসঙ্গতি হলো “সুরা মজলিশের” শব্দের ব্যবহার। “মজলিসে শুরা/শূরা” টার্মটি জামায়াতের ইসলামীর সাংগঠনিক চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।জামায়াতের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, “সংগঠন” সেকশনে “কেন্দ্রীয় সংগঠন” এর তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে “কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা/শূরা” (“সুরা মজলিস” নয়)। একটি দলের পরিচয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন মৌলিক একটি টার্ম সেই দলের প্রধান ব্যক্তির লেখা আনুষ্ঠানিক নিদের্শনামায় ভুলভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।দেখুন স্ক্রিনশট-

জামায়াতের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন প্রতিবেদনে “মজলিসে শুরা/শূরা” টার্মটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও “সুরা মজলিস” এমনভাবে লেখা পাওয়া যায়নি। দেখুন নিচের স্ক্রিনশট–

প্রথম প্রকাশকারীদের পরিচয় কী?একটি স্পর্শকাতর গোপনীয় নথি প্রকাশের দাবি করা (সূত্রহীনভাবে) ফেসবুক পেইজটি কী ধরনের কার্যক্রম করে থাকে- তা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছে BD FactCheck. স্পর্শকাতর তথ্যের নির্ভযোগ্যতার ক্ষেত্রে সেটির প্রকাশকারীর পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।”সেই রাজাকার এই রাজাকার” নামক ফেসবুক পেইজটিতে প্রকাশিত সর্বশেষ ১০টি পোস্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এসব পোস্টের সবক’টিই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা ভিত্তিক। ১০টি পোস্টের প্রতিটিতে বাংলাদেশের বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারপূর্ণ ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও কোথাও বিরোধী পক্ষের নেতাদের নাম বিকৃতি এবং তাদের ব্যাপারে গালিবাচক শব্দ ব্যবহারও রয়েছে। নিচে পেইজটি সর্বশেষ ৫টি পোস্টের (একটি পিনড পোস্টসহ) স্ক্রিনশট দেখুন–

আগে ভুয়া খবর প্রচার করা হয়েছে এই পেইজ থেকে:“সেই রাজাকার এই রাজাকার” পেইজটির গত ২১ সেপ্টেম্বরের একটি পোস্টকে ফেসবুক ‘ভুয়া তথ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেখুন এই লিংকে।

উপসংহার:উপরিউক্ত বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান যে, জামায়াতে ইসলামীর নামে প্রচার করা নোটিশটির সত্যতার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।