
ভুয়া তথ্য মোকাবেলায় করোনাভাইরাস সম্পর্কিত যে ৮টি বিষয় জানা জরুরি
Author: BD FactCheck Published: December 6, 2020, 1:51 pm | Updated: December 6, 2020, 10:59 pm
প্রযুক্তির সহায়তায় ইন্টারনেটের এই অবাধ বি সময়ে যেকোন মহামারীতে ফ্যাক্ট এর চেয়ে ভুয়া তথ্য কখনো কখনো বেশি ছড়াতে পারে। করোনাভাইরাস কিংবা কোভিড-১৯ নিয়ে অসংখ্য গুজব ও অসত্য দাবির গ্যাড়াকলে আপনি দ্বিধায় পড়ে যেতে পারেন যে লবন পানি দিয়ে গড়গড়া করলে করোনা সারবে নাকি করোনাভাইরাস নিজেই চীনের একটি ল্যাবরেটরীতে মানুষের হাতে তৈরী।
এসব ভ্রান্তি দূর করতেই এখানে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ৮ টি ফ্যাক্ট তুলে ধরা হলো যাতে এর সাথে দ্বান্দ্বিক কোন তথ্য দেখলে যে কেউ সতর্ক হতে পারেন।
১. করোনাভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধে মাস্ক সহায়তা করে
বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মুখ ঢেকে রাখার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের ঝুকি কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর ডিরেক্টর রবার্ট রেডফিল্ড গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন সিনেটের সামনে এক বক্তব্যে বর্তমান মহামারী মোকাবেলায় মাস্ককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে প্রমাণসহ দেখান।
মাস্ক নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোতে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তব্য ভূমিকা রেখেছে যেখানে তিনি বলেছেন যে করোনা আক্রান্তদের শতকরা ৮৫ ভাগই মাস্ক পরা ছিলেন। মূলত তার এই দাবিটি সিডিসির একটি গবেষণাকে ভুলভাবে বিশ্লেষণ করার কারণে উঠেছিল।
ওয়াশিংটন পোস্টের ফ্যাক্ট চেকিং টিম দেখিয়েছে যে করোনা আক্রান্তদের বেশীরভাগই করোনা পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং কাছাকাছি সময়ে এরা রেস্টুরেন্টে খেয়েছেন।
মাস্ক তখনি কাজ করবে যখন এটা পরা হবে। মাস্ক ব্যবহারের পর এটিকে কি করা হয় সেটিও একটি ব্যাপার। অনেকে বলতে পারেন তারা সবসময় মাস্ক পরে থাকেন কিন্তু বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় খুলে ফেলেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই ঝুকি বেড়ে যায়।
২. এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর কোন প্রতিষেধক নেই
যখন কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক খুব দরকার তখন এর চিকিৎসা করতে কোন ঔষধ নেই। গত বছর চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পর থেকে এর প্রতিষেধক নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক অসত্য দাবি ছড়ানো হয়ছে। ব্লীচ পান করা থেকে কোকেন ফুঁকা পর্যন্ত দাবিও এর মধ্যে রয়েছে। কোভিড এর চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও পরীক্ষা করার সামগ্রীর ভুয়া নিশ্চয়তা দেয়া বিভিন্ন কোম্পানীকে এখন পর্যন্ত ১৫০ টির মতো সতর্কতা চিঠি পাঠিয়েছে সিডিসি।
প্রকৃতপক্ষে কোভিড-১৯ এর চিকিতসা খুবই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এখন পর্যন্ত রেমডিসিভির ও বামলানিভিমাব এই দুইটি ঔষধকে জরুরী ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
৩. হাসপাতাল কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট দেয়ার কোন কারণ নেই
বিভিন্ন হাসপাতাল আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট দেয় বলে একটি অসত্য দাবি ছড়িয়েছিল। মূলত গত এপ্রিলে ফক্স নিউজকে মিনেসোটার গভর্ণর স্কট জেনসেন এর দেয়া একটি ইন্টারভিউ থেকে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল যেখানে তিনি বলেছিলেন যে কোভিড রোগীদের জন্য অতিরিক্ত প্রণোদনা দিলে তারা রোগীদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে কেয়ার অ্যাক্টে ইন্স্যুরেন্সবিহীন করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালগুলোকে বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার একটি ধারা আছে কিন্তু কোন হাসপাতাল এই ধারার অপব্যবহার করছে এরকম কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি। তাছাড়া স্কট জেনসেন নিজেও পরবর্তীতে FactCheck.org কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন যে তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন না হাসপাতালগুলো এভাবে এই ধারার অপব্যবহার করছে।
প্রকৃতপক্ষে হাসপাতালগুলো কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারণ এর চিকিৎসা খুব জটিল এবং অনেক সময় রোগির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে।
৪. করোনাভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে ভয়ঙ্কর
দূর্ভাগ্যজনকভাবে করোনাভাইরাস মৌসুমী ফ্লু এর চেয়েও ভয়ঙ্কর। করোনাভাইরাসের মৃত্যুহার আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ২ ভাগ যেখানে সাধারণ ফ্লু এর মৃত্যুহার আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ০.২ ভাগ।
তাছাড়া সাধারণ মৃত্যুকে কোভিড এ মৃত্যুর সাথে যোগ করে ডাক্তাররা করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে বলছেন এই দাবিটিও সত্য নয়। কারণ কোন মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের আগে ডাক্তাররা রোগীর সংক্রমণ, চিকিৎসায় সাড়া প্রদান এবং তার মেডিকেল তথ্য বিবেচনায় নেন।
৫. করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিনগুলো মানুষের ডিএনএর ক্ষতি করে না
এফডিএর অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার ভ্যাকসিন দুটি মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করার অন্যতম উদাহরণ। এই এমআরএনএ প্রযুক্তি মানব শরীরে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরীর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং করোনাভাইরাস প্রতিহত করতে সহায়তা করে। এটি অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় ভিন্ন কারণ সেগুলোতে একই ভাইরাসের নিষ্ক্রিয় কিংবা অপেক্ষাকৃত দূর্বল একটি সংস্করণকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সামনে উপস্থাপন করা হয়। সিডিসির তথ্য অনুযায়ী আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী ভ্যাকসিন মানুষের ডিএনএর কোন ক্ষতি করেনা।
৬. ঘরে থাকা, স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং হাত ধোওয়ার অভ্যাস স্বাস্থ্যকর
করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে এই অভ্যাসগুলো মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য কোন হুমকি না। যদিএ এরকম দাবি অনেকে করেছেন।
কম সময় ঘরের বাইরে থাকা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ক্ষতি করবে এই ভ্রান্ত ধারণাটি মূলত হাইজিন তত্ত্ব থেকে নেয়া যেখানে বলা হয়েছে রোগ জীবানুর সাথে শিশুদের বসবাস তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। কিন্তু ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সূত্রমতে এই তত্ত্বটি বড়দের জন্য প্রযোজ্য নয় কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে।
তাছাড়া স্যানিটাইজার ব্যবহার ও হাত ধোওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হবে এই দাবিও সঠিক নয় কারণ ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এই দাবির পেছনে কোন উপযুক্ত প্রমাণ নেই।
৭. বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রাণী থেকেই করোনাভাইরাসের উতপত্তি
অনেকে দাবি করেন যে করোনাভাইরাস চীনের একটি ল্যাবরেটরীতে তৈরী কিন্তু বিজ্ঞানীরা নিয়মিতভাবেই বলে আসছেন যে এটি পুরোটাই প্রাকৃতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবেই উৎপত্তি হয়েছে। অবশ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই ব্যাপারটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
৮. শুধু ঝুকিপূর্ণ বয়স্ক ব্যাক্তিদের পৃথক করে দিলেই বাকিরা ভালো থাকতে পারবেন না
দূর্বল ব্যক্তিদের ঘরে থাকার কথা বলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন এই দাবীটিও সত্য নয় কারণ প্রথমত: এটা সম্ভব নয়, এবং দ্বিতীযত: গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা নিয়ে ৪৯ কিংবা এর চেয়ে কম বয়সী মানুষের হাসপাতালে ভর্তির হার শতকরা ২৩.১ ভাগ।
Washingtonpost অবলম্বনে