গণমাধ্যম

গণমাধ্যম

December 30, 2020, 9:17 am

Updated: December 30, 2020, 9:26 am

ভুয়া ভিডিওতে যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয়

Author: Zahed Arman Published: December 30, 2020, 9:17 am | Updated: December 30, 2020, 9:26 am

ভুয়া ভিডিও তৈরিতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কণ্ঠ, ছবি ও ভাবভঙ্গি হুবহু নকল করা হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের কাছে এসব নকল কারবার সত্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়াতে সেসব ভিডিও খুব সহজেই প্রকাশ ও বিপণন করা যাচ্ছে। ফলে ভুয়া ভিডিও সহজলভ্য একটি পণ্য হিসেবে সবার কাছেই হাজির হচ্ছে।

ছবি কিংবা কোনো লিখিত বক্তব্যের ফ্যাক্ট-চেক যত সহজে করা যায়, তার তুলনায় ভিডিওর ফ্যাক্টচেক করা একটু কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ভুয়া ভিডিওতে যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয় তা জানা থাকলে খুব সহজেই এসব ভিডিওর ফ্যাক্টচেক করা যাবে। এই প্রবন্ধে ভুয়া ভিডিওতে ব্যবহার করা হয় এমন কিছু কৌশল পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।

এক – ভিডিওর ভুল ব্যাখ্যা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কিছু ভিডিও দেখা যায় যেগুলো পুরোপুরি সত্য কিন্তু এর সাথে যে বর্ণনা জুড়ে দেয়া হয় তা মিথ্যা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রথম ধাপে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়ানো হয় যাতে দাবি করা হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা ভাইরাসের ভয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনছেন।

প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের। কভিড-১৯ মহামারির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তুতপক্ষে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার সময় অন্য ধর্মগ্রন্থের পাশিপাশি কুরআনও পাঠ করা হয়। সে সময়কার একটি ভিডিওকে করোনাভাইরাস মহামারির সময়কার ভিডিও বলে ছড়ানো হয়েছিলো। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে এই লিংকে

দুই – জোড়াতালি দেয়া ভিডিও

একটি সম্পূর্ণ ভিডিওর আগের কিংবা পরের বক্তব্য জুড়ে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যাতে করে ভিডিওটির সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। ফুটেজগুলো একই ভিডিও থেকে নেয়া হয় বলে ভিডিওতে বক্তার পোশাক থেকে শুরু করে ব্যাকগ্রাউন্ড সব একই থাকে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়। 

২০২০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওটির শিরোনাম ছিলো, “ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে খালেদা জিয়া যা বলেছিলেন“। ২৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “ক্ষমতায় তো থাকি তারপর দেখা যাবে কী হয় দেশ নিয়ে। এই দেশ দিয়ে আর কী দরকার। আমরা যতদিন পাই থাকি, লুটেপুটে খাই দাই আরাম করে থাকি, তারপরে এই দেশ নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নাই।” তিনি আরও বলেন, “চেয়ারে বসেছি এমন শক্ত করে, শক্ত করে ধরে রাখতে হয় না। ওই আছেনা কী, কী একটা এড দেয় না, ফেভিকল না কী একটা আঁটা? ফেভিকল লাগায়া বইসা গেছি, কাজেই এখান থেকে আর উঠছি না, নড়ছি না।”

অথচ ভিডিওর বক্তব্যটি বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন দেন নি। দিয়েছেন ২০১৭ সালে ছাত্রদলের ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে। ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড দীর্ঘ মূল ভিডিওর দুটি জায়গা থেকে দুটি অংশ কেটে অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুক্ত করে ২৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। খালেদা জিয়া যেসব কথা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে বলেছেন, সেই কথাগুলোকেই এডিট করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে আপত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এসব কথা তিনি তার নিজের এবং নিজের দলের (বিএনপির) অবস্থান হিসেবে বলছেন।

তিন – এডিট করা ভিডিও

অনেক সময় ভিডিওকে এমনভাবে এডিট করা হয় যাতে করে বক্তার বক্তব্যের প্রধান অংশটা বাদ পড়ে যায়। ফলে আসল ভিডিওতে বক্তা যে কথা বলছেন সম্পাদনার পরে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। 

২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য ভিত্তিক একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। এতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “আপনারা যতই বলেন, আন্দোলন ঢাকায় সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। এখানে আমার পরিবারের মধ্যে গন্ডগোল আছে। তারেক রহমানকে তো আপনারা ভালো করে চিনেন। বউয়ের সঙ্গে ওর গন্ডগোল। বউ চায় ক্ষমতা, সেও চায় ক্ষমতা।” এই ভিডিও দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রীকে নিয়ে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেছেন।

কিন্তু বিডি ফ্যাক্টচেক-এর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে লন্ডনের পার্ক প্লাজায় বেগম জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটিকে সম্পাদনা করে উপরের বক্তব্যটুকু বানানো হয়েছে। সেই বক্তব্যে বেগম জিয়া বলেছেন, “এই এরশাদ প্রথমে অংশগ্রহণ করে নাই। এরশাদ কিন্তু রংপুর থেকে তার সিট উইথড্র করেছে। ঢাকা থেকে করতে চেয়েছে, জোর করে তাকে করতে দেয়া হয়নি। এরশাদ কিন্তু অংশগ্রহণ করতে চায়নি। এখানে আবার পরিবারের মধ্যে গন্ডগোল আছে। তাকে তো আপনারা ভালো করে চিনেন। বউয়ের সঙ্গে ওর গন্ডগোল। বউ চায় ক্ষমতা, সেও চায় ক্ষমতা। এরশাদকে যখন পারছে না তখন সিএমএইচে বন্দী করেছে।” দেখুন মূল ভিডিওটি। এখানে এই বক্তব্যটিকে প্রধান রেখে আরও কয়েকটি বক্তব্য থেকে খালেদা জিয়ার মুখে উচ্চারিত বিভিন্ন শব্দ নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে এটি বানানো হয়েছে। এছাড়া এডিট করা ভিডিওর ফুটেজে খালেদা জিয়ার চেহারাকে জুম-ইন করে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড বোঝা না যায়। 

চার – ভিডিওর উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন

ক্রপিং, ভিডিওর স্পিড কমানো বা বাড়ানো, ফটোশপের মাধ্যমে ভিডিওর মূল আধেয়তে পরিবর্তন নিয়ে আসা, ভিডিওর ফ্রেমিং চেঞ্জ করা ইত্যাদি নানাভাবে পুণরুৎপাদন করা যায়। এছাড়া আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং-এর ব্যবহারের মাধ্যমে ভিডিওর ছবি এবং শব্দে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। 

১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনেটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) যখন চাঁদে মানুষ বাহিত যান পাঠান। ওই অভিযান ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন কী ভাষণ দিবেন তা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অভিযানটি সফল হয়েছিলো এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওই বক্তব্য কখনওই দেননি। অর্থাৎ এই ঘটনাটি ঘটেনি। সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ভার্চুয়ালিটি “ইন ইভেন্ট অব মুন ডিজাস্টার” শীর্ষক একটি প্রজেক্টে সেই ঘটনাই সত্যি করে দেখানো হয়। যে ঘটনা ঘটেনি সেটিকেই ভিডিও ডায়ালগ রিপ্লেসমেন্ট, ভয়েস কনভার্সন সিস্টেম ও  আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বাস্তবের মতো করে উপস্থাপন করেছেন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *