
মালিকানার প্রভাব: সংবাদমাধ্যম থেকে সংবাদ গায়েব হয়ে যাওয়ার একটি দৃষ্টান্ত
Author: BD FactCheck Published: December 6, 2020, 4:45 pm | Updated: December 6, 2020, 9:54 pm
৫ ডিসেম্বর সময় টিভির অনলাইনে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম “ইউল্যাবের বহিষ্কৃত দুই শিক্ষার্থী গ্রেফতার“।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা মামলায় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) বহিষ্কৃত দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে শনিবার (৫ ডিসেম্বর) তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
গ্রেফতাররা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজমের ৮ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মাহমুদ রায়হান আতিক ও সাদাত রুহুল।”
একই ঘটনার খবর প্রকাশ করেছে দেশ রূপান্তর। তাদের প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
দেশ রূপান্তর এর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে–
“টিউশন ফি কমানোসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনের জের ধরে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ- ইউল্যাবের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার দুই শিক্ষার্থী হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজ ও জার্নালিজম বিভাগের ৮ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মাহমুদ সাদাত রুহুল ও রায়হান আতিক।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের বিষয়ে একটি নোটিশ জারি করে। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগের চার দফা দাবির পাশাপাশি দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করে উল্টো মামলা করে।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ মোহাম্মদপুরের ইউল্যাব ক্যাম্পাস এলাকা থেকে ওই দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে। ইউল্যাবের নিরাপত্তা বিভাগের ম্যানেজার তৌফিক আজিজ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মিটিংয়ে আছি। পরে ফোন দেন।’”
প্রতিবেদনের সাথে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি অ্যাকশনের একটি ছবিও প্রকাশ করে ’দেশ রূপান্তর’। সেটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “শনিবার দুপুরের দিকে আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ক্যাম্পাসের বাইরে শিক্ষার্থীরা জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করলে সেখান থেকে পুলিশ দুজনকে ধরে নিয়ে যায়।”

উপরের প্রতিবেদন দুটি থেকে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যে, কী ঘটেছিলো।
এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে। যেমন ডেইলি স্টার এর বাংলা ভার্সন, নিউ এইজ, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, নিউ নেশন, রাইজিং বিডি ইত্যাদি।
৬ ডিসেম্বর দুপুরে অনলাইনে সার্চ করে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের মধ্যে উপরের উল্লিখিত মাধ্যমগুলোতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অবশ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড তাদের “Two students held over vandalism at Ulab” শিরোনামের প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলেছে।
তবে তাদের প্রতিবেদনের ক্যাশে ভার্সন আর্কাইভ করা আছে এখানে।
মূলধারার বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এবং সেখান থেকে দুইজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুয়েকটিতে প্রকাশিত হলেও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মতো পরে সরিয়ে নেয়া হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে বিডি ফ্যাক্টচেক। তবে সেগুলোর লিংক সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
মূলধারার হিসেবে পরিচিতি দুটি সংবাদমাধ্যম হলো অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন এবং ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউন। এই দুটি সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক হলেন ব্যবসায়ী কাজী আনিস আহমেদ। এমন তথ্য উভয় ওয়েবসাইটের নিচে ‘পাবলিশার্স লাইন’-এ উল্লেখ করা আছে।
আবার ইউল্যাব এর বোর্ড অব ট্রাস্টি-এর ভাইস চেয়ারম্যান হলেন জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ। তার বাবা কাজী শাহেদ আহমেদ ইউল্যাব এর বোর্ড অব ট্রাস্টি এর প্রেসিডেন্ট এবং জেমকন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাদের পরিবারের অন্য কয়েকজন সদস্যও ইউল্যাব এর বোর্ড অব ট্রাস্টিতে রয়েছেন।
বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনে ইউল্যাব এর ৫ ডিসেম্বর শিক্ষার্থী গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। ৫ তারিখ পুরো দিনে বাংলা ট্রিবিউনের বাংলা ভার্সনে মোট ১৪৩ টি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটির আর্কাইভে ওই দিনের সবক’টি প্রতিবেদন ঘেটে ইউল্যাব সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ইংরেজিতেও কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি এ সংক্রান্ত। আর্কাইভের লিংক এখানে।
ঢাকা ট্রিবিউনে ওয়েবসাইটে আর্কাইভ সেকশনটি সক্রিয় নয়। তবে ৫ তারিখের সবক’টি সংবাদ ঘেটে দেখা গেছে ইউল্যাবে বিক্ষোভ বা ছাত্র গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো খবর নেই।
বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইটে সার্চ বাটন ব্যবহার করে ‘ইউল্যাব’ লিখে সার্চ দেয়ার পর ১০০টির মতো ফলাফল আসে। সেগুলোর মধ্যে ইউল্যাবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ছাত্র বিক্ষোভ, ছাত্র বহিষ্কার এবং সর্বশেষ গতকাল ৫ ডিসেম্বর দুইজন ছাত্রকে গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো খবর নেই।

বরং সার্চ রেজাল্টে আসা ১০০টি ফলাফলের প্রায় সব’টিই ইউল্যাব সংক্রান্ত ইতিবাচক প্রতিবেদন। রেজাল্টে সবার ওপরে আসা কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, “গবেষণায় এগিয়ে যাবে ইউল্যাব”, “ইউল্যাব যেন ১২ হাজার বছর টিকে থাকে: কাজী শাহেদ আহমেদ”, “ক্যারিয়ার বিষয়ক ওয়েবিনার আয়োজন করেছে ইউল্যাব”, “ইউল্যাব ও এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর” ইত্যাদি।
ঢাকা ট্রিবিউনে ইউল্যাব নিয়ে কী ধরনের সংবাদ অতীতে প্রকাশিত হয়েছে তা দেখতে সার্চ দেয়া হয়েছিলো ওয়েবসাইটটিতে। ছাত্র বিক্ষোভ, বহিষ্কার ও গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া না গেলেও ইতিবাচক নানান সংবাদ নিকট অতীতে প্রকাশিত হয়েছে বলে দেখা গেছে। যেমন সার্চ রেজাল্টে আসা প্রথম তিনটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, “Higher Education Review: ULAB among world’s top 10 universities for mass communication”, “Science Film Festival begins online”, “‘Promote diversity, tolerance to protect people from radicalization’ এবং “ULAB celebrates ranking among top 50 global universities”

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছেে ইউল্যাব এবং বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের মালিকানায় একই ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছেন। এবং ইউল্যাব সংক্রান্ত ইতিবাচক নানান খবর নিয়মিত এই দুটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, নেতিবাচক খবর, বিশেষ করে ইউল্যাবে সংঘটিত সর্বশেষ ছাত্রবিক্ষোভ, বহিষ্কার এবং গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো খবরই প্রকাশ করেনি বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন।