
লস এঞ্জেলসের একজন চিকিৎসক যেভাবে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য মোকাবেলা করছেন
Author: BD FactCheck Published: December 21, 2020, 7:04 pm | Updated: December 21, 2020, 8:24 pm
পুরো ২০২০ জুড়ে যখন করোনার দাপটে বিশ্ব নাজেহাল, ভ্যাকসিন তখন টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর একটি রেখা হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে আবার আছে অনেক ভুল বুঝাবুঝি, ভুয়া তথ্যের প্রকোপ এবং গুজব।
লস এঞ্জেলসের ডা. এলিসা নিকোলাস তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নানা ভুল বুঝাবুঝি, সন্দেহ এবং গুজবের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন।
যতদুর জানা যায়, লস এঞ্জেলসে করোনায় সবচেয়ে বিপদে পড়েছে সেখানকার লাতিন আমেরিকার লোকেরা। এরা মূলত লস এঞ্জেলসের নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকাগুলোতে থাকেন। দেখা গেছে, তাদের করোনায় মৃত্যুহার অন্যদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। গত সপ্তাহের সেখানকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাতে তা জানা যায়। এসব এলাকার মধ্যে লং বিচ অঞ্চলটিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে লাতিন আমেরিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গরা। ডা. নিকোলাস মনে করেন, এই অবস্থায় ভ্যাকসিন খুব ভাল ভুমিকা পালন করতে পারে।
কিন্তু দেখা গেল, ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গুজব চাউর হয়ে গেছে চারিদিকে। ‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সাইন্টিস্ট’ সংগঠনটি দেখিয়েছে, কিভাবে এই অঞ্চলগুলোতে স্প্যানিশ ভাষায় ভুয়া খবর ছড়াচ্ছিল। ভ্যাকসিন বিরোধী বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর আর্টিকেলের সন্ধান পেয়েছিল তারা।
ডা. নিকোলাস ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় রোগীদের কাছ থেকে বেশ কিছু ভুয়া-বিভ্রান্তিকর তথ্যের সন্ধান পান। যেমন একজন রোগী তাকে জানান যে, তারা শুনেছেন ভ্যাকসিনের সাথে শরীরে মাইক্রোচীপ প্রবেশ করানো হবে। এতে সবার গতিবিধি ট্র্যাক করা যাবে। তবে ডা. নিকোলাস জানান, সেই রোগীটি নিজের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। মূলত সে তার কলিগদের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি নিয়ে আলাপ করতে শুনেছেন।
ডা. নিকোলাস জানান, তিনি এই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বটি শুনে অবাক হননি। তিনি আরো মনে করেন এমন অনেকগুলো ভুয়া তথ্য রোগীদের চিন্তায় প্রভাব ফেলছে। তিনি ভ্যাকসিনে মাইক্রোচিপ থাকার ব্যাপারটিকে মিথ্যা বলেই মনে করেন।
ডা. নিকোলাসকে সেই নারী জিজ্ঞেস করেন তার ভ্যাকসিন নিতে হবে কেন? তার ধারণা, করোনায় তো মারা যায় কেবল অসুস্থ্য এবং বয়স্করা। নিকোলাস তাকে বুঝান, কেন তার ভ্যাকসিন নেয়া প্রয়োজন এবং এতে কিভাবে সমগ্র দেশের সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব। নিকোলাস বলেন, “এই ভ্যাকসিন ৯৫% শতাংশের ক্ষেত্রেই কার্যকর। কিন্তু সমগ্র জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩০ ভাগ লোক সেই ভ্যাকসিন নিলে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবেনা।”
এরপর ডাঃ নিকোলাস একজন রেস্তোরা শ্রমিকের সাথেও ভ্যাকসিন নিয়ে আলাপ করেন। তিনি মনে করেন, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক জনগন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা বাধা তৈরি করছে করোনা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য।
যেমন, কৃষ্ণাঙ্গ এক দাদীমার সাথে আলাপে ডাঃ নিকোলাস জানতে পারেন, তিনি তার পরিবারের লোকদের পোলিও এবং মেনিনজাইটিসের টিকা দিয়েছেন। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। দাদিমা জানান, তার ধারণা সরকার করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে কালোদের দিয়ে মূলত কোনো একটি গবেষণা করতে চাইছে।
তার এই দাবির পিছনে অবশ্য ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। ১৯৩২ সালে ‘টাস্কেজি এফেক্ট’ নামে একটি গবেষণা হয়েছিল যেখানে ৬০০ এর অধিক কৃষ্ণাঙ্গকে একটি সিফিলিস গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে কোন প্রকার অনুমতি তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়নি এবং এতে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মারা যাযন। ১৯৭২ সালে উক্ত গবেষনা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে কালোদের মধ্যে সেই আতঙ্কটি এখনো বহাল আছে। এছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জার এবং করোনার ভ্যাকসিনের মধ্যে তফাত করতে পারছেন না তাদের অনেকে।
ডা. নিকোলাস সেখানে চিকিৎসক এবং স্থানীয় কর্তাদের নিয়ে একাধিক সেমিনার করেছেন। সেখানে আলাপ করে ডা. নিকোলাস বুঝতে পারেন যে, ব্রিটেনে প্রথম ভ্যাকসিনে ট্রায়ালে কিছু নেতিবাচক ফলাফল আসে, যাতে মানুষের মধ্যে সন্দেহের বীজ তৈরি হয়। মূলত ভ্যাকসিনের সেই ট্রায়ালে কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়ার খবর গণমাধ্যমে চলে আসে যা অবশ্য পরবর্তীতে সমাধান করা হয় বলেও নিকোলাস সবাইকে জানান। এছাড়াও কোনো ভ্যাকসিন যথাযথ গাইডলাইন অনুসরণ না করে বাজারে আসতে পারেনা বলেও আশ্বস্ত করেন নিকোলাস।
খুব দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন বাজারে চলে আসাতেও অনেকের মধ্যে তার মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আবার কেউ কেউ ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমের সাথে দেশের সরকার জড়িত থাকাকেও ভাল চোখে দেখছেন না। এই ব্যাপারেও ডা. নিকোলাস তাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, কোভিড-১৯ নতুন রোগ হলেও কাছাকাছি অনেকগুলো ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে এর আগেও গবেষণা হয়েছে। ফলে দ্রুত এই ভ্যাকসিন আবিস্কার হয়ে যাওয়া খারাপ কিছু নয়।
ডাঃ নিকোলাস বলেন, “আমরা একটি মহামারি অবস্থায় আছি এবং মৃত্যুহারও বেশ উল্লেখযোগ্য। আর ভ্যাকসিন ছাড়া এই অবস্থা থেকে পার পাওয়া যাবেনা।” এছাড়া তিনি সর্বত্র মাস্ক পরার জন্যেও সবাইকে সচেতন করছেন।
newsbreak.com অবলম্বনে