
সমরাস্ত্রের সঙ্গে আরেক অস্ত্র মিসইনফরমেশন
Author: BD FactCheck Published: October 10, 2020, 3:23 am | Updated: October 10, 2020, 3:23 am
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যেকার চলমান যুদ্ধের খবর সংবাদসচেতন মানুষ মাত্রই অবগত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের মূলে রয়েছে নাগারনো-কারাবাখ নামে একটি অঞ্চল। আজারবাইজানের এই অংশটি প্রায় তিন দশক আগে দখল করে শাসন করছে আর্মেনিয়ার মদদপুষ্ট গোষ্ঠিরা। এটি নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ-সংঘর্ষ হয়েছে। এবার অঞ্চলটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে আজেরিরা। অন্যদিকে দখল বহাল রাখতে জান বাজি রাখছে আর্মেনিয়ানরাও।
মুখোমুখি যুদ্ধের ময়দানে দুপক্ষ একে অন্যকে মোকাবেলা করছে নানান ধরনের অস্ত্র দিয়ে। তবে লড়াই শুধু সমরাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। উভয় পক্ষ যুদ্ধ করছে তথ্য দিয়েও। আরও স্পষ্ট করে বললে- মিসইনফরমেশন বা ভুল তথ্য দিয়ে।
যুদ্ধ শুরুর পর আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আজারবাইজান-তুরস্ক মিলে ‘মিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইন’ চালাচ্ছে। বলা হয়েছে, আজারবাইজানের পক্ষ থেকে ছড়ানো অনেক ‘ভুয়া তথ্য’ই প্রমাণ করে আজেরি-তুর্কিরা কতটা ‘হিতাহিত জ্ঞানশূন্য’ হয়ে পড়েছে।
“আজারবাইজান বিভিন্ন ধরনের ভুয়া তথ্যের প্রচার করে আর্মেনিয়ান বেসামরিক লোকদের উপর হামলা করার ব্যাপারটিকে আড়াল করতে চাচ্ছে”, এমন দাবি আর্মেনিয়ার। আবার আজারবাইজানের যেসব এলাকায় হামলা করেনি আর্মেনিয়া সেসবের নাম উল্লেখ করে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রুশ সমর্থনপুষ্ট ইয়েরবেনের।
অন্যদিকে একই রকম অভিযোগ আজারবাইজানেরও– বাকুর বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে আর্মেনিয়া। আজেরি ভাইস-প্রেসিডেন্ট মেহরিভান আলিয়াভা তার অফিসিয়াল ইন্সটাগ্রামে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, “যুদ্ধের পাশাপাশি আর্মেনিয়ার সব মিথ্যা তথ্যের ব্যাপারেও আমাদের সবাইকে সৈনিকের ভূমিকায় থাকতে হবে।” তার দাবি, আজারবাইজান যখন একটি সফল অপারেশনের দ্বারপ্রান্তে তখন আর্মেনিয়া নানান প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছে। প্রবাসী আর্মেনিয়ানরাও বিশ্বকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আজেরি ভাইস প্রেডিসডেন্টের।
দুই পক্ষের নেতারা যেমন একে অন্যের দেশকে ‘মিসইনফরমেশন’ বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করছেন, বাস্তবেও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে দুটি দেশের এবং তাদের মদদদাতা বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে। উভয়পক্ষেই উভয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে সম্ভব তথ্যকে ব্যবহার করছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র থেকে। কিছু ক্ষেত্রে উগ্রজাতীয়তাবাদী মিডিয়াও অংশ নিচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচার এবং ভুয়া তথ্য প্রচারের অভিযোগ তোলার ক্যাম্পেইনে।
সম্প্রতি আজারবাইজানের একজন জেনারেল মাইর বারখুদারভকে গ্রেফতার করা হয়েছে মর্মে খবর ছড়ানো হয় আর্মেনিয়ান বিভিন্ন সূত্র থেকে। কিন্তু আজারবাইজান এমন তথ্য নাকচ করে দিয়ে আর্মেনিয়ান কর্তৃপক্ষকে এ ধরণের গুজব ছড়ানোর জন্যে দায়ী করে।
আবার আজারবাইজানের পক্ষ থেকে ছড়ানো এক ভিডিওতে দেখা যায়, দেশটির জনৈক সৈনিক যুদ্ধপীড়িত অমীমাংসিত অঞ্চলে ঢুকে স্থানীয় নারীদের সাথে আলাপ করছেন। ভিডিওটির আরেক অংশে দেখা যায়, আর্মেনিয়ার বোমা হামলা থেকে বাচার চেষ্টা করছেন এক সাংবাদিক।
কিন্তু পরে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হয়, উক্ত ভিডিওটি শুটিং করে তৈরি করা। এছাড়াও ভিডিওতে প্রদর্শিত সৈনিকটি এবং সাংবাদিকটি আসলে একই ব্যক্তি। আরও বলা হয়, “আজারবাইজানের ‘প্রপাগান্ডা মেশিন’ এতই সহায়সম্বলহীন যে তাদের শুটিংয়ে একাধিক চরিত্রের জন্যে একাধিক ব্যক্তি তারা ব্যবস্থা করতে পারেনি।”
আর্মেনিয়া এমন কড়া ভাষায় ভিডিওটি অস্বীকার করলেও নিরপেক্ষ কোনো সংবাদমাধ্যম বা ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার পক্ষ থেকে সেটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উল্টোদিকে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখপাত্র সুশাল স্টেপেনয়ান তার ফেসবুকে একটি পোস্টে দাবি করেন, আর্মেনিয়া আজারবাইজানের একটি জ্বালানী মজুদকেন্দ্রে হামলা করে নিকটস্ত যুদ্ধঘাটিতে থাকা অন্তত ২০০ আজেরি সৈনিককে হত্যা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আজারবাইজানি পত্রিকা www.azerbaycan24.com উক্ত তথ্যকে ভূয়া দাবি করে জানায়, যুদ্ধঘাটি কখনো জ্বালানি মজুদকেন্দ্রের পাশে করা হয় না। বিশেষ করে যখন কোনো যুদ্ধ চলমান।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রকাশিত খবরে আজারবাইজান দাবি করেছে আর্মেনিয়ার সৈনিকদের মধ্যে বিদেশি সেনার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আবার একইভাবে আর্মেনিয়া থেকে সরকারি বরাতে জানানো হয়েছে, আজারবাইজানের পক্ষে সিরিয়ার সৈন্যরা যুদ্ধ করে সেখানে নানা অঞ্চলে শরিয়া কায়েম করে ফেলছে। যদিও দাবি দুটির কোনো সত্যতা পায়নি আল-জাজিরা।
তাছাড়াও যুদ্ধাঞ্চল কারাবাখ’র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, তারা আজারবাইজানের চারটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে। সাথে একটি ছবিও প্রচার করে তারা। যদিও রয়টার্স ফ্যাক্টচেক করে জানায় যে, ছবিটি আসলে সিরিয়ার একটি বিমান ভূপাতিত করার ভিডিও থেকে নেয়া।
নাগারনো-কারাবাখ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আজেরি-আর্মেনিয়ান যুদ্ধের মধ্যে ‘তথ্যযুদ্ধ’ সে সীমানাকে ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধরত দুই দেশের সংবাদমাধ্যম, সামাজিকমাধ্যম ছাপিয়ে আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমেও তথ্যের যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি উভয়পক্ষে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে মদদ দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব দেশের মধ্যে আর্মেনিয়ার পক্ষে রয়েছে রাশিয়া, ইরান, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইত্যাদি দেশ। অন্যদিকে আজারবাইজানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক, ইসরায়েল, পাকিস্তান এসব দেশ।
তুরস্ক খোলাখুলিভাবেই আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে। তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি “আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার লড়াইয়ে ভুয়া তথ্যের প্রবাহ” শিরোনামে একটি খবরে দাবি করছে, উক্ত যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ভুয়া তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে আর্মেনিয়া। যুদ্ধটিকে তারা ‘পবিত্র যুদ্ধ’ হিসেবে দাবি করে ‘মুসলিম-বিরোধী’ আবেগকে উস্কে দিতে পারে উঠে এসেছে টিআরটির প্রতিবেদনে।
এছাড়াও গ্রিস-আর্মেনিয়া-সার্বিয়া যৌথভাবে তুরস্কের বিরুদ্ধে আজারবাইজান যুদ্ধে সিরিয়ার ‘আইএস সেনাদের’ অন্তর্ভুক্ত করার গুজব ছড়াচ্ছে বলেও দাবি সংবাদমাধ্যমটির। এছাড়াও রয়টার্স-গার্ডিয়ান পত্রিকার দিকেও গুজব ছড়ানোর ইংগিত দেয়া হয় সেখানে। তবে টিআরটির ভিডিওটি প্রতিবেদনে আজারবাইজানের পক্ষ থেকে ছড়ানো কোন ভুয়া খবরের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
একইভাবে গ্রিসের গ্রিকটাইমস-এর প্রতিবেদনে আজারবাইজানের প্রপাগান্ডা ও ভুয়া খবর উন্মোচন করে তুরস্ক-আজারবাইজানের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। এ দুটি দেশের সরকারব্যবস্থা ‘একনায়কতান্ত্রিক’ হিসেবে উল্লেখ করে গুজব ছড়ানোর জন্যে দায়ী করে গ্রীসের পত্রিকাটি। উল্লেখ, নানা দ্বি-পাক্ষিক ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা তুরস্ক ও গ্রীসের অবস্থানকে প্রভাবিত করছে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংকটেও।
আল জাজিরার আরেকটি খবরানুযায়ী, একাধিক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হয়ছে যেখানে বলা যাচ্ছে ইরান থেকে অস্ত্রভর্তি ট্রাক আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করছে। সেটিও পরবর্তীতে ভুয়া বলে দাবি করেন ইরানের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র সায়্যিদ খতিবজাদেহ। পরবর্তীতে জানা যায়, সেই ট্রাকগুলো অস্ত্রের নয়, গাড়ির নানা যন্ত্রাংশের।
আবার জর্জিয়ার বিরুদ্ধেও একই রকম অভিযোগ করা হয় যে, তারা আজারবাইজানে সীমান্ত-পথ দিয়ে অস্ত্র চালান করছে। জর্জিয়া-ভিত্তিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সেটিকেও অস্বীকার করে জর্জিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্র মন্ত্রী লাশা দারসালিয়া বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা উক্ত অঞ্চলে ট্রানজিট কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। এছাড়া আর্মেনিয়ার সরকারকে ভুয়া তথ্যে কান না দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের উপর নজর বাড়াতে আহবান জানান তিনি।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চল চেচনিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যিনি আবার আজারবাইজান-বংশোদ্ভূত এলখান সুলায়মানভ ইন্সটাগ্রামে চেচেন সেনাদের যুদ্ধাঞ্চলে অংশগ্রহণেরএকটি ভিডিও পোস্ট করে আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। কিন্তু পরে জানা যায় যে, ভিডিওটি মূলত ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকটকালের।
এর বাইরেও আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার এই যুদ্ধের হাওয়া এসে লেগেছে দক্ষিণ এশিয়ার খবরমাধ্যমগুলোতেও। পাকিস্তান এ সংকটে আজারবাইজানকে সমর্থন জানানোর পর ভারতের একাধিক মিডিয়ায় খবর আসে, পাকিস্তানের সেনারা আজারবাইজানের পক্ষে লড়ছে এই যুদ্ধে। এছাড়াও জি নিউজের সাথে এক স্বাক্ষাৎকারে আর্মেনিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেন যে, “দাবিটি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা”।
তবে সেটিকে প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এ দাবিকে ‘অনুমান-নির্ভর এবং ভিত্তিহীন’ বলে উল্লেখ করে এ ধরনের কাজকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে বিবৃত করা হয়।
যুদ্ধে আর্মেনিয়ার প্রতি সহানূভিশীল ভারতীয় কিছু পত্রিকায় খবর প্রচারিত হয় যে, আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে আজারবাইজানে পারমানবিক হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো হুমকির খবর আর্মেনিয়া বা আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধের সময় তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারার চেষ্টা যুদ্ধ ইতিহাসের সমান পুরোনো। তবে বর্তমান সময়ে তথ্য প্রবাহের নানান আধুনিক উপায় রাষ্ট্র এবং সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকায় এই চেষ্টাকে সফল করাও সহজ হয়েছে। আর এতে বাড়ছে ভুল তথ্য বা মিসইনফরমেশনের দৌরাত্ম।