
ডিপফেইক কীভাবে যাচাই করবেন?
Author: Zahed Arman Published: December 20, 2020, 8:31 am | Updated: December 20, 2020, 8:40 am
ডিপফেইক হচ্ছে ফটোশপ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সাহায্যে বাস্তবে ঘটে নাই এমন সব ঘটনাকে বাস্তবের মতো করে উপস্থাপন করা। ফলে অডিয়েন্সের মনে হয় এইসব ঘটনা বাস্তব।
১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনেটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর চাঁদে পাঠানো মানুষ বাহিত অভিযান ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কী বক্তব্য দিবেন তা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিলো। যেহেতু এই অভিযান সফল হয়েছিলো তাই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওই বক্তব্য কখনওই দেন নি। কিন্তু ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ভার্চুয়ালিটি তাদের “ইন ইভেন্ট অব মুন ডিজাস্টার” শীর্ষক একটি প্রজেক্টে সেই ঘটনা সত্যি করে দেখানো হয়। যেখানে রিচার্ড নিক্সনকে বলতে শোনা যায়, “শুভ সন্ধ্যা আমেরিকান জনগণের প্রতি। যারা চাঁদের বুকে শান্তি অন্বেষণ করতে গিয়েছিল তারা সেখানেই চিরদিনের জন্য শান্তিতে বিশ্রাম নিবেন। নীল আর্মোস্ট্রং এবং এডওয়ার্ড অলম্যানকে উদ্ধারের কোনো আশা আর নেই।” বাস্তবে এই বক্তব্য রিচার্ড নিক্সন কখনও দেননি। এধরনের ডিপফেইক ভিডিও বানাতে ডায়ালগ রিপ্লেসমেন্ট, ভয়েস কনভার্সন সিস্টেম, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডিপফেইক ট্র্যাককারী প্রতিষ্ঠান সেনসিটি বিশ্বব্যাপী ডিপফেইক মনিটরিং এবং শনাক্তকরণের কাজ করে থাকে। সেনসিটি এ পর্যন্ত ৪৬০ টি উৎস থেকে প্রায় ৮২ হাজার ডিপফেইক চিহ্নিত করেছে। এসব ডিপফেইকে অন্তত চার হাজার পাবলিক ফিগারকে টার্গেট করা হয়েছিলো। সংস্থাটির মতে, সবচেয়ে বেশি ডিপফেইক ছড়ানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে (৪৪.২%)। এরপর যুক্তরাজ্য (১০.৪%), সাউথ কোরিয়াতে (৮.৬%), ইন্ডিয়া (৫.৪%) ও জাপানে (৫%)। বাকি ২৬.২ শতাংশ ডিপফেইক ছড়ানো হয়েছে অন্য দেশসমূহে। এসব ডিপফেইকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টার্গেট করা হয়েছে বিনোদন জগতকে (৬৪%)। এরপর যথাক্রমে ফ্যাশন (২০.৩%), রাজনীতি (৪.৬%), ব্যাবসায় (৪%), খেলাধূলা (৪%), এবং অন্যান্য খাতে ৩.১ শতাংশ।
ডিপফেইক কিভাবে যাচাই করবেন?
যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান নর্টন কিছু কৌশল উল্লেখ করেছেন যেগুলোর সাহায্যে সহজে ডিপফেইক চিহ্নিত করা যাবে। তবে এসব কৌশল সমানভাবে কাজ নাও করতে পারে। কারণ, আজকে ডিপফেইক চেনার যে কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে কাল তা হয়তো ডিপফেইক প্রস্তুতকারকরা উৎরে যেতে পারে। ডিপফেইক তৈরিতে যেমন নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে তেমনি ফ্যাক্টচেকাররাও তা চিহ্নিত করার নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। এখানে ডিপফেইক চিহ্নিত করার জন্য কিছু কৌশল তুলে ধরা হলো।
চোখের কৃত্রিম মুভমেন্ট: ডিপফেইকে সাধারণত চোখের মুভমেন্ট প্রাকৃতিক হয়না। ডিপফেইক ভিডিওতে অনেকক্ষেত্রে চোখ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। ডিপফেইক প্রস্তুতকারকদের জন্য চোখকে প্রাকৃতিকভাবে মুভমেন্ট করানো একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই কাজ করে। অনেক সময় দেখা যায় চোখের মুভমেন্টের সাথে অডিওর মিল হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এধরণের ভিডিওকে ডিপফেইক হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারেন।
মুখের কৃত্রিম অভিব্যক্তি: মুখের কৃত্রিম অভিব্যক্তি দেখেও ডিপফেইক চিহ্নিত করা যেতে পারে। ডিপফেইক তৈরি করা হয় সাধারণত দুইজনের ছবির মিলগুলো খুঁজে বের করে একজনের ছবির উপর অন্যজনের মুখভঙ্গি বসিয়ে দিয়ে। কিন্তু সবসময় তা শতভাগ প্রাকৃতিক হয় না।
শরীরের সাথে মুখাবয়বের অবস্থান: যদি কারও শরীরের সাথে মুখাবয়বের অবস্থান ঠিক না থাকে অর্থাৎ মুখ এক দিকে আর নাক অন্যদিকে থাকে তবে সহজেই ভিডিওটিকে ডিপফেইকের সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারেন।
আবেগের অভাব: মানুষ মুখে যা বলে তা সাধারণত তার মুখাবয়বে ফুটে ওঠে। দূর থেকে দেখেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলে দেয়া যায় কেই হাসির কথা বলছে না দুঃখের কথা বলছে। যদি কারও বক্তব্যের সঙ্গে তার মুখাবয়বের মিল খুঁজে না পান তাহলে সে ভিডিওটি ডিপফেইক হতে পারে।
বেমানান দেহাবয়ব: ডিপফেইক প্রস্তুতকারকরা ব্যক্তির শরীরের চেয়ে মুখের বৈশিষ্ট্যগুলোতে বেশি মনোনিবেশ করে। ফলে এ ধরণের ভিডিওতে ব্যক্তির শরীরের সাথে মুখের নানান ধরণের অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এসব ভিডিওতে ব্যক্তির দেহের আকার প্রাকৃতিক দেখায় না।
কৃত্রিম শারীরিক মুভমেন্ট: ভিডিওতে যদি এক ফ্রেম থেকে আরেক ফ্রেম আলাদা করা যায় কিংবা ভিডিওতে ঝাঁকুনি থাকে তাহলে সেই ভিডিওকে ডিপফেইক হিসেবে সন্দেহের চোখে রাখতে পারেন। এই ধরণের ভিডিওতে কেউ পাশ ঘুরলে কিংবা মাথা ঘুরালে ছবি বিকৃত হয়ে যায়।
কৃত্রিম চুল: ডিপফেইক ভিডিওতে আপনি কোঁকড়ানো বা উড়ে যাওয়া চুল দেখতে পাবেন না। কারণ ভুয়া ভিডিও চুলের এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরি করতে সক্ষম নয়।
কৃত্রিম দাঁত: কম্পিউটারের অ্যালগরিদম পৃথক দাঁত তৈরি করতে সক্ষম নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি ভিডিওতে ব্যক্তির দাঁতগুলির বাহ্যরেখা ঠিকমতো বোঝা না যায় তাহলে এটি ডিপফেইক চিনার একটি উপায় হতে পারে।
অস্পষ্টতা: যদি ভিডিওতে ছবির বিভিন্ন প্রান্ত ঝাপসা হয়ে থাকে কিংবা একটা প্রান্তের সাথে আরেকটা প্রান্ত না মিলে তাহলে সেগুলিকে ডিপফেইক হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারও মুখ এবং ঘাড় যদি শরীরের সাথে মিলে যায় তাহলে ভাববেন কোনো একটা কিন্তু অবশ্যই আছে।
অসঙ্গতিপূর্ণ অডিও: ডিপফেইক প্রস্তুতকারকরা অডিওর চেয়ে ভিডিওতে বেশি নজর দেয়। ফলে অনেকসময় অডিও অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। যদি কোনো ভিডিওতে ঠোঁটের নড়াচড়া অডিও ক্লিপের সাথে না মিলে, রোবটিক কণ্ঠ শোনা যায়, শব্দের উচ্চারণে সমস্যা মনে হয়, ডিজিটাল ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ শোনা যায় অথবা অডিও না থাকে তাহলে সেসব ভিডিও ভুয়া হতে পারে।
জুম-ইন করে দেখা: ভিডিওকে জুম-ইন করে দেখার সময় কিংবা বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে ধীর গতিতে দেখার সময় যদি চিত্রগুলি অপ্রাকৃত দেখায় তাহলে ভিডিওটি ভুয়া হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জুম-ইন করে সাবজেক্টের বিভিন্ন অংশ দেখতে পারেন। এটি আপনাকে দেখতে সাহায্য করবে যে তারা সত্যিই কথা বলছে নাকি মুখাবয়ব স্থির আছে।